মৃত, করোনা শনাক্ত সবাই চার দেয়ালে বন্দী

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ছাত্রজীবনে ছুটির নোটিশ হলো সবচেয়ে আনন্দের। দীর্ঘদিন লেখাপড়া করার পর একঘেয়েমি জীবন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ছুটির বিকল্প নেই।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি ঘোষণার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। নোটিশ শোনার পর কালবিলম্ব না করে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিই বাড়ির উদ্দেশে। আগের ছুটিগুলো ছিল অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও হই–হুল্লোড়ে পূর্ণ। কিন্তু এবারের ছুটিটা একেবারে বিরক্তিকর।

বর্তমান প্রেক্ষাপট এমন, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাঁরা কবরের চার দেয়ালে বন্দী। যাঁদের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাঁরা হাসপাতালের চার দেয়ালে বন্দী। যাঁরা এখনো সুস্থ আছেন, তাঁরাও বাড়ির চার দেয়ালে বন্দী।

বাতাসে বাতাসে এখন শুধু শোনা যায় চাপা আর্তনাদ‌। প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্বের মানুষ এখন মৃত্যুর শঙ্কায় নিপতিত। এই বুঝি মৃত্যু এল!
বিশ্ব পরিস্থিতির কথা ভাবলে প্রাণটা আঁতকে ওঠে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকাও এই ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে পরাজিত সৈনিক।
করোনা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে সবার জীবন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি‌। প্রতিটি দিন একই রুটিনে চলে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়া সারা দিন বসে থাকি ঘরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছটির তলায়। এই নিমগাছই আমার নিঃসঙ্গতা জীবনের একমাত্র বন্ধু। এ কদিনে গাছটি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে।
মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে বাড়ির বাইরে যাই, কিন্তু মন বাইরে থাকে না। সবার মুখে মুখে শুধু দেখি হতাশার ছাপ। আর হাসি জিনিসটাকে মনে হয় নিছক অতীত।

বাবার দিকে তাকালে নিজের অজান্তেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সদা হাস্যোজ্জ্বল এমন লোকের মুখে এখন শুধুই হতাশার প্রতিচ্ছবি। আমার বাবা একজন ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ী। দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় ধরে হোটেল বন্ধ ছিল, সঙ্গে আয়ও বন্ধ। সঞ্চয়ের যা টাকা আছে তা দিয়ে অনায়াসেই দিন যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে যে কী হবে, আল্লাহই ভালো জানেন।
আগে ছুটিতে বাসায় এলে আব্বা-আম্মা সর্বদা আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত।কত কী রান্না করে খাওয়াত, কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। কোনো দিন ডাল-ভাজি দিয়ে ভাত খেয়েই দিন পার করতে হয়। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই, তবে দুঃখ আমার আব্বা-আম্মার। অনেক দিন পর বাড়িতে আসা আমাকে যে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াতে পারছে না, এটাই তাদের দুঃখ।
আমার গ্রামের অধিকাংশ মানুষ খুবই অসচেতন। করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ, অথবা অর্থাভাবে লকডাউন বিষয়টাকে তারা তেমন তোয়াক্কা করে না। আমি তাদের যতই বোঝাতে চেষ্টা করি, তারা এটাকে নিছক ছেলেখেলা মনে করে। তবে দীর্ঘদিন বোঝানোর পর এখন তারা কিছুটা সচেতন। এখন তারা সর্বদা মাস্ক পরে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে।
আগে ছুটিতে বাসায় আসার পর দিনের অধিকাংশ সময় খেলার মাঠে থাকতাম। কিন্তু এবার আর খেলার মাঠের দিকে তাকানোই হয় না। খেলার সরঞ্জাম ও খেলার সাথি আছে ঠিকই, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খেলাধুলার আগ্রহ এখন শূন্যের কোঠায়।
আগে ছুটিতে বাসায় এলে আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতাম, কিন্তু এবার আর যাওয়া হয়নি।
একেই তো মন–মানসিকতা খারাপ, তার ওপর আবার যান চলাচল বন্ধ। তাই বাড়ির চার দেয়ালেই এখন আমার পৃথিবী।
তবে করোনাকালে আমার ভাবনার জগৎটা অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। চোখ বন্ধ করলেই ফিরে যাই দীর্ঘদিন ধরে দূরে সেই চিরচেনা দারুল নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে। দেখি আবার সেই আগের মতোই চলছে মাদ্রাসা কার্যক্রম। সেই আবাসিক হলে কারি সাহেব হুজুরের মিষ্টি ডাকে ফজরের সময় ঘুম ভেঙে যাওয়া, ক্লাস, প্রাণপ্রিয় সব শিক্ষকের পাঠদান, বন্ধুবান্ধব সব আগের মতোই।
কিন্তু কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসি তখন অনুভব করি, চোখের অশ্রু অজান্তেই গাল বেয়ে পড়ছে।
আবার মাঝেমধ্যে কল্পনার জগতে পাড়ি জমালে দেখি, দিন হলেই মানুষের কোলাহলে মুখরিত ভুবন, সবার মুখে আবার আগের মতোই হাসি। সবাই সবার কর্মস্থলে কর্মব্যস্ত। রাস্তায় রাস্তায় যানবাহন আবার আগের মতোই চলছে। পৃথিবী আবার আগের মতো হয়ে গেছে।

*শিক্ষার্থী: দারুল নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা, ডেমরা, ঢাকা। [email protected]