সরকারি খাদ্য মজুত দ্রুত বাড়াতে হবে

আখতার আহমেদ ।
আখতার আহমেদ ।

এই বছরটা দেশের খাদ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে চিন্তা করলে পরিস্থিতি বেশ ভালোই ছিল। দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় মৌসুম হচ্ছে বোরো ধানের মৌসুম। এর বড় অংশ কৃষকের গোলায় উঠে গেছে। গম, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের মতো আমদানি-নির্ভর পণ্যগুলোর আপাতত কোনো সংকট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দেশের খাদ্য পরিস্থিতির সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয় এখন বিতরণ ও সরকারি মজুত ব্যবস্থাপনাকে ঠিক রাখা। দেশের বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা এখন বড় চিন্তার বিষয়। ব্র্যাক ও পিপিআরসির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় আমরা দেখলাম, দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা করোনার কারণে দ্বিগুণ হয়েছে। আগে থেকে যারা গরিব ছিল, তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে করোনার কারণে গরিব মানুষের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব।

গরিব মানুষদের সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা দিয়ে থাকে। করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে থাকা শহরের বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষ, অনানুষ্ঠানিক হাতের ওপর প্রধানত যাদের জীবিকা নির্ভরশীল, যাদের বড় অংশ বস্তি ও উন্মুক্ত স্থানে বসবাস করে। এসব মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যসহায়তা দেওয়া দরকার। এদের মধ্যে অল্প টাকায় হলেও চাল-গম বিক্রি করতে গেলে নানা সমস্যা দেখা দেবে। আবার তালিকা করে দিতে গেলে সেই তালিকা সঠিক হলো কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। সঠিক লোক খাবার পাবে কি না, সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। ফলে আমার পরামর্শ হচ্ছে, এসব গরিব মানুষের বসতি এলাকা, অর্থাৎ বস্তি এলাকায় বিনা মূল্যে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। পাক্ষিক বা মাস ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তাদের কাছে দ্রুত খাবার পৌঁছানো দরকার।

গ্রামে যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিব মানুষকে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া হয়, সেগুলোর সবই যে খুব কার্যকর, তা কিন্তু নয়। এসব কর্মসূচি যেসব তালিকার ভিত্তিতে হয়, তা নিয়েও নানা ধরনের সমস্যা আছে। তবে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, সরকারের কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষদের যে তালিকাটি হয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে সঠিক। সেই তালিকা ধরে গ্রামীণ দরিদ্রদেরও দ্রুত খাদ্যসহায়তা দেওয়া উচিত।

সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর বিস্কুট দেওয়া হতো। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় সেটি আর দেওয়া যাচ্ছে না। তবে শুনেছি ওই বিস্কুট মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি একটি ভালো ও কার্যকর উদ্যোগ বলে মনে করছি। সারা দেশে ওই বিস্কুট পৌঁছে দিলে এই সময়ে মানুষের পুষ্টির যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে এই খাবার দেশের সব গরিবের মধ্যে দেওয়া গেলে ভালো হয়।

সরকারকে খাদ্য বিতরণব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি খাদ্য মজুত পরিস্থিতির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সরকার নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেভাবে চাল-গম বিতরণ করছে, তাতে মজুতে দ্রুত টান পড়বে। সে জন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে চাল দরকার হবে। এই চাল কোথা থেকে আসবে, তা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। সরকার এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে সেই সংগ্রহ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। শুনেছি সম্প্রতি সংগ্রহের গতি কিছুটা ধীর হয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মানুষের মধ্যে চাল-গম বিতরণ বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাল-গম সংগ্রহ না হলে দেশে খাদ্য নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। ফলে সংগ্রহ বাড়াতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা ও মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল কেনার পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে চাল কেনার ব্যবস্থা করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দ্রুত চাল কেনা সম্ভব না-ও হতে পারে। আর করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম ও সরবরাহব্যবস্থা কেমন দাঁড়ায়, তা-ও বলা যাচ্ছে না। তাই দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকেই দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি রাখতে হবে।

করোনার মাঠপর্যায়ে সবজি, পোলট্রি মুরগি ও মাছের বিপণনের যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। একদিকে উৎপাদন হচ্ছে আর অন্যদিকে ভোক্তারা তা সঠিক দামে পাচ্ছেন না। অর্থনীতির ভাষায় একে আমরা বলি মার্কেট ফেইলর বা বাজারের ব্যর্থতা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার হয়। সরকার সবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য পরিবহনের ব্যাপারে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু এই উদ্যোগ আরও বড় এবং বিস্তৃতভাবে নেওয়া উচিত। সরকারের তত্ত্বাবধানে কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদকদের কাছ থেকে নিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ট্রাক, বাস, রেল, নৌযানসহ সব যানবাহনে বিশেষ ব্যবস্থাপনা দ্রুত তৈরি করা উচিত। নয়তো তা একই সঙ্গে দেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

লেখক: কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট