ছেলের শোক ভুলছেন মানবসেবায়

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অসহায় মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন পায়েল ফাউন্ডেশনের সদস্যরা । ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অসহায় মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন পায়েল ফাউন্ডেশনের সদস্যরা । ছবি: সংগৃহীত

নিজের চেয়েও প্রিয় ছোট ছেলেকে হারিয়েছেন মর্মান্তিকভাবে। শেষবারের মতো ছেলের মুখটা দেখবেন সেই সৌভাগ্যও হয়নি। এরপর থেকে নিজের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কোহিনূর বেগমের জীবন। এখনো প্রায় প্রতিদিনই বাসার বাইরে ভেসে আসে এই মায়ের কান্নার আওয়াজ। সেই শোকের মধ্যেও এই মা ছেলের নামে গড়ে তুলেছেন একটি ফাউন্ডেশন। এখন সেই ফাউন্ডেশনের হয়ে নিজের সারাজীবনের জমানো টাকা এবং স্বামী ও প্রবাসী বড় ছেলে থেকে পাওয়া সহায়তা ব্যয় করে চলেছেন মানবসেবায়।

এই কোহিনূর বেগম দুই বছর আগে নির্মমভাবে হত্যার শিকার রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েলের মা। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতবাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নিখোঁজ হয়েছিলেন পায়েল। ২৩ জুলাই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ভবের চরে পায়েলের লাশ পাওয়া যায়। শরীর বিকৃত হয়ে যাওয়ায় স্বজনেরা কোহিনূর বেগমকে ছেলের লাশ দেখতে দেয়নি।

এরপর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে—পায়েল বাথরুমের কথা বলে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। পুনরায় গাড়িতে ওঠার সময় আহত হয়েছিলেন তিনি। রক্তাক্ত পায়েলকে হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে মুখ থেঁতলে নদীতে ফেলে দেন বাসের কর্মীরা। এ ঘটনায় মামলা করে পায়েলের পরিবার। এই মামলায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারধীন।
২০১৯ সালের ২ নভেম্বর পায়েলের জন্মদিনে মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করেন কোহিনূর বেগম। তাতে সায় দেন স্বামী আর বড় ছেলেও। পায়েল ছিলেন মামাদেরও কাছে বড় আদরের। সেই মামাদের একজন ব্যবসায়ী ফাহাদ চৌধুরী উদ্যোগী হন বোনের ইচ্ছা পূরণে। গড়ে তোলেন 'পায়েল ফাউন্ডেশন'।

নিহত পায়েল
নিহত পায়েল

পায়েল ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন পায়েলের বন্ধুরা। হালিশহর এলাকায় তিন হাজার নিমগাছ রোপণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। পরে বেশ কিছু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় তারা। তবে করোনার এই সময়ে সবচেয়ে বেশি মানবিক সহায়তা করেছে তারা। এ পর্যন্ত অসহায়, হতদরিদ্র, ভাসমান ও মধ্যবিত্ত প্রায় চার হাজার মানুষের হাতে এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিনের শুকনা খাবার তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একাধিক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়া একটি পরিবারকে এক মাসের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ তুলে দেয় এই ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া পুলিশের সদস্য ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের লাশ দাফন করার কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামও সরবরাহ করা হয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।
এই ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন কোহিনূর বেগম। আর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন তাঁর ছোট ভাই ফাহাদ চৌধুরী। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে কোহিনূর বেগম ঘরের বাইরে তেমন বের না হওয়ায় মূলত ফাহাদ চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। ফাহাদ প্রথম আলোকে বলেন, গত আড়াই মাসে ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকার সহায়তা মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সামনে আরও অনেকের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা আছে তাঁদের।
নিহত পায়েলের মা কোহিনুর বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‌'ছেলেকে হারিয়ে এখনো শোকের সাগরে ডুবে আছি। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়েই আনন্দ খুঁজে নিচ্ছি। আমি চাই না আমার মতো কেউ অমানবিকতার শিকার হোক। সে জন্য যাঁরা সহায়তা পাচ্ছেন, তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মানবিক হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।'

আরও পড়ুন:

বাসচালকসহ তিনজনের বিচার শুরু
'রাস্তায় ফেলে গেলেও ছেলেটা বাঁচতে