নওগাঁয় সরকারি গুদামে ধান দিতে কৃষকের অনাগ্রহ

পানি ও কাদা মাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িতে জমি থেকে ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন কৃষক। সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ার ভাঙ্গাগড়া এলাকায়। ছবি: মঈনুল ইসলাম
পানি ও কাদা মাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িতে জমি থেকে ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন কৃষক। সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ার ভাঙ্গাগড়া এলাকায়। ছবি: মঈনুল ইসলাম

নওগাঁয় সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কৃষকেরা। ধান সংগ্রহ অভিযান শুরুর দেড় মাসে মাত্র ৩৯৪ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে। গুদামে ধান বিক্রয়ের জন্য নির্বাচিত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও গুদামে ধান দিতে আগ্রহী করা যাচ্ছে না।

স্থানীয় কৃষক ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যায়, ধানের বর্তমান বাজারদর ও গুদামে ধান ক্রয়ের সরকার–নির্ধারিত দাম প্রায় সমান। এ পরিস্থিতিতে গুদামে ধান বিক্রি করে কৃষকদের তেমন লাভ থাকবে না। তার ওপর কৃষকদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার। আর্দ্রতার কথা বলে প্রতি মণে এক-দুই কেজি করে বেশি ধান নেওয়া হয়। অনেক সময় ধান ফেরতও দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এসব ঝক্কি-ঝামেলা নেই।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলায় কৃষকের অ্যাপের মাধ্যমে এবং বাকি ১০টি উপজেলায় লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকদের কাছ থেকে সরকারি গুদামে ধান ক্রয় করা হবে। জেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৪০ মেট্রিক টন। প্রতি মণ ১ হাজার ৪০ টাকা (২৬ টাকা কেজি) দরে ১৪ শতাংশ নিচের আর্দ্রতার ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে লটারির মাধ্যমে ২৯ হাজার ৪০০ এবং কৃষকের অ্যাপে আবেদন করা কৃষকদের মধ্য থেকে ২ হাজার ৯০০ কৃষককে সরকারি গুদামে ধান বিক্রির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল থেকে জেলায় সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৯টি সরকারি খাদ্যগুদামে মাত্র ৩৯৪ টন ধান কেনা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার ১ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ৯৫ শতাংশ জমিতেই জিরা ও কাটারিভোগ জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। বাকি জমিতে সুগন্ধি ও বিআর-২৮ ধানের চাষ হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ হাটবাজারে বর্তমানে প্রতি মণ কাটারীভোগ ৯৮০-১০০০ টাকা, জিরা ১ হাজার ২০ টাকায় ও বিআর-২৮ ধান ৯২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর ইউনিয়নের বুধুরিয়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ দানেশ মণ্ডল এ বছর ৪৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। বিঘাপ্রতি গড়ে ২০ মণ করে মোট ৯০০ মণ ধান পেয়েছেন তিনি। মৌসুমের শুরুতে বাজারে ধানের দাম কম থাকায় সরকারি গুদামে ধান বিক্রির জন্য লটারিতে নাম লেখান। গুদামে ধান দেওয়ার জন্য লটারিতে তিনি নির্বাচিতও হন। কিন্তু কিছুদিন পরেই বাজারে ধানের দাম বেড়ে যায়। এখন সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই।

দানেশ মণ্ডল বলেন, ‘গুদামে যে দামে ধান বিক্রি করব, সেই দাম বাজারেই পাচ্ছি। বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ম্যালা ঝক্কি-ঝামেলা করে তাইলে কেন গুদামে ধান দিতে যাব? আগে ধান দিতে গিয়ে ধানের রং ভালো না, আর্দ্রতা বেশি, এসব কথা বলে ম্যালা হয়রানি করেছে। লাভ বেশি হলে হয়তোবা এসব হয়রানি মেনে ধান দিতাম।’

দানেশের মতো নওগাঁর কৃষকেরা সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। গুদাম কর্তৃপক্ষ কৃষকদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ধান বিক্রির জন্য অনুরোধ জানিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছে না।

নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর এলএসডি (স্থানীয় সরবরাহ গুদাম) খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, সরকারি যে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, স্থানীয় বাজারেও সেই দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে। যে কারণে খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে নির্বাচিত কৃষকেরা আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অথচ লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচনের সময় প্রচুর কৃষক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এখন ধান বিক্রির জন্য ফোন করেও তাঁদের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জি এম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী বলেন, গত দেড় মাসে কম ধান সংগ্রহের একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমান বাজারদর ও সরকারি দাম প্রায় সমান। এবার ধান কাটা শুরু হয়েছে কিছুটা পরে। এ কারণে কৃষকেরা সরকারি গুদামে ধান দিতে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন। তবে ধান সংগ্রহের এখনো বেশ সময় রয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান সংগ্রহ করা হবে। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত সব কৃষক গুদামে ধান দেবেন এবং সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হবে।