রাজশাহীতে করোনাকালে মেস ভাড়ায় ছাড় পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা

রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তিন বছর ধরে নগরের বালিয়াপুকুর এলাকার একটি মেসে থাকতেন। ইন্টারনেট সংযোগ, বুয়াসহ একক একটি কক্ষের জন্য প্রতি মাসে ভাড়া পড়ে ২ হাজার ৫০ টাকা। করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় তিন মাস হলো তিনি বাড়িতে। ৮ জুন তিনি মেস ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যান। জুন মাসের এক সপ্তাহ হলেও তাঁকে এ মাসসহ আগের তিন মাসের ৬ হাজার ১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। মেসমালিক তাঁকে কোনো ধরনের ছাড় দেননি। ইঁদুর তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেটে ফেলেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

রাজশাহীতে মেস ভাড়ার চাপের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এভাবে মেস ছেড়ে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, মেস ভাড়ার জটিলতা নিরসনে গত ১০ মে ‘রাজশাহী মেস মালিক সমিতি’র সঙ্গে আলোচনায় বসে জেলা প্রশাসক বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানান, এপ্রিল মাস থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ৪০ শতাংশ মেস ভাড়া মওকুফ পাবেন। এই সিদ্ধান্ত অনেক শিক্ষার্থী তখন মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এক মাস না যেতেই আরেকটি নতুন সংগঠন থেকে আরেক সিদ্ধান্ত আসে। যার ফলে করোনা পরিস্থিতিতে মেসে না থাকলেও ভাড়া থেকে ছাড় পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মো. সোহানুর রহমানের বাড়ি নাটোরের নলডাঙ্গায়। তিনি রাজশাহী নগরের শিরোইল ২ নম্বর গলির একটি মেসে থাকতেন। করোনায় তাঁর পরিবারের আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। মেস ভাড়া নিয়ে মালিকপক্ষ কোনো ছাড় না দেওয়ায় তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে মেস ছেড়েছেন। তবে মেসমালিক তাঁর কাছ থেকে মে মাসের ভাড়াও আদায় করেছেন। তাঁর মেসের ভাড়া ছিল ১ হাজার টাকা করে।

নগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জানান, ১০ মে জেলা প্রশাসক দপ্তর থেকে ৪০ শতাংশ মওকুফের সিদ্ধান্ত আসার পর গত ১৭ মে ‘রাজশাহী মহানগর মেস মালিক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। তারা ঈদের পর ২৮ মে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১ জুন একটি ‘জরুরি নোটিশ’ দেয়। এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের এপ্রিল-মে-জুনের পুরো ভাড়াই দিতে হবে। যদি কোনো শিক্ষার্থীর পরিবার করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, সে ক্ষেত্রে মেসমালিকেরাই বিবেচনা করে সর্বোচ্চ মেস ভাড়ার ছাড় দেবেন।

এই অবস্থায় অতিরিক্ত ভাড়া গুনেই মেস ছেড়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ‘রাজশাহীর মেসভাড়া মওকুফের দাবি’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানা যায়, কয়েক শ শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে মেস ছেড়েছেন। ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া প্রথম আলোকেও অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী মেস ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সোহানুর রহমানসহ অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি থামতে আরও অনেক সময় লাগবে। আর মেসমালিকেরাও শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে ভাড়া নিয়ে চাপাচাপি করছেন। এই পরিস্থিতিতে সবাইকে একজোট হয়ে মেস ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে। শিক্ষার্থীরা জানান, রাজশাহীতে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রায় সবার আবাসিক হল নেই। করোনা পরিস্থিতির পর শিক্ষার্থীদের কাজ হবে একজোট হয়ে দ্রুত আবাসিক হল স্থাপনের জন্য আন্দোলনে নামা।

‘রাজশাহী মহানগর মেস মালিক সমিতি’র নেতারা জানান, সমগ্র রাজশাহী নগরকে প্রতিনিধিত্ব করে এই ধরনের কোনো মেস মালিক সমিতি রাজশাহীতে নেই। তাই তাঁরা কয়েক দফা নিজেরা বসার পর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর গত ১৭ মে ‘রাজশাহী মহানগর মেস মালিক সমিতি’ নামে একটি নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। পরে মেসভাড়া নিয়ে গত ২৮ মে সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সমিতির প্রধান উপদেষ্টা মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হকসহ নগর মেস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

রাজশাহী মহানগর মেস মালিক সমিতির সভাপতি মো. এনায়েতুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নতুন সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছেন কিছুদিন হলো। মেসমালিকদের কাছে অনেক শিক্ষার্থীই পারিবারিক অবস্থার কথা বলছেন। মেসমালিকেরা সে বিষয়ে বিবেচনা করে ছাড় দিচ্ছেন। তবে কতজনকে এ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে, সে তথ্য তাঁর কাছে নেই।

শিক্ষার্থীদের মেস ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে মেস ছেড়ে দিতে পারেন। তবে তাঁর জানা মতে খুব বেশি শিক্ষার্থী মেস ছাড়ছেন না। তিনি আরও বলেন, তাঁরা জুন মাস শেষ হলেই জুলাই থেকে মেস ভাড়া বিষয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আরও ভালো সিদ্ধান্ত দেবেন। এ জন্য শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে হবে।

রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, কোনো ছাত্র যদি দরিদ্র হয়, মানবিক কারণে তাঁদের ছাড় দেবেন। বিষয়টা সামনে রেখে মেসভাড়ার বিষয়টি আমরা বিবেচনা করতে বলেছিলাম। কারণ যেহেতু এটা তাঁদের ব্যবসা।’ মেসমালিকদের চাপ দিত পারেন না উল্লেখ করে সাংসদ আরও বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি মেয়র অথবা তাঁকে বলেন যে তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, এ কারণে যদি তাঁর শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁদের (মেয়র-সাংসদ) পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দিলে মেসমালিকেরা তা মানবেন বলে তিনি আশা করেন।