পৃথিবীতে এক রোগ এসেছে

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এই তো কিছুদিন আগেকার কথা। অন্যান্য দিনের মতো সূর্য উঠেছে, সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো কর্মব্যস্ত শহরে বেরিয়ে পড়েছে। মনে কিছুটা ভয়, কারণ অন্যান্য দেশে একটা রোগ এসেছে। মানুষ মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকছে। কেউ কাছে আসছে না। অনেকে মারা যাচ্ছে, অনেকে আবার সুস্থ হয়ে উঠছে। শুনেছি, এই রোগের কোনো ওষুধ আজও আবিষ্কার হয়নি। মনে ভয় নিয়েই সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই খবরের পাতায় চোখ রাখছে কেন যেন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজও সুস্থ আছে। সবাই দোয়া দুরুদ পড়ছে। ভয়ংকর রোগ এসেছে পৃথিবীতে। চারদিকে মৃত্যুর হাহাকার, কান্না। তবে সেদিনও কেউ বুঝিনি আজকের এই দিনে আমরাও দাঁড়িয়ে থাকব।


দিনটি ছিল ৮ মার্চ। কিছুদিন হলো মায়ের কাছে থাকছি না। সব সময়ের মতো ক্লাস করে রুমে এসে খাওয়াদাওয়া শেষে ক্লান্ত–শ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে যাই। ঘুমটা ভাঙে মায়ের ফোনে। ওপাশ থেকে মায়ের গলা আজ কিছুটা ভারী লাগছে। ‘আব্বু, আজকে তিনজন করোনা রোগী পাইছে, সাবধানে থাকিস। বাইরে বের হস না। সন্ধ্যার পর বাইরে যেয়ে চা খাওয়ার দরকার নাই। কারও সঙ্গে মিশবি না। আর বৃহস্পতিবার ক্লাস করে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসিস।’ ফোনটা রেখে ফেসবুকে নিউজফিডের শুরুতেই দেখি করোনা রোগী শনাক্তের খবর। সবার মনেই আতঙ্ক, ভয়।

ছুটিতে বাসায় গিয়ে শুনতে পেলাম, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। না, আজ কোনো উৎসবের জন্য ছুটি নয়। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ। চারদিকে এক অজানা আতঙ্ক। আজ ছুটির নিউজ পেয়ে আর খুশি লাগছে না। মনের কোণে এক অজানা ভয়। সেদিন যে বাসায় গেলাম আর বের হতে পারিনি। প্রতিটি দিন যেন বিভীষিকাময়। প্রথম প্রথম ভালো লাগছিল। কারণ, এই প্রথম অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ক্লাস বন্ধ। তখনো পাড়ার খেটে খাওয়া মানুষ তাদের জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে যাচ্ছে। কর্মব্যস্ত শহর যেন ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ভয়, আমাদের দেশেও বুঝি অবশেষে করোনা নামক অজানা এক ভাইরাস হানা দিয়েছে। এদিকে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে আমাদের দেশের করোনা রোগীর আক্রান্তের হার। মৃত্যুও যেন সমান তালে এগোচ্ছে।

অবশেষে ২৫ মার্চ আমাদের সবকিছু বন্ধ, সবাই পুরোপুরি বাসার ভেতর বন্দী। পাড়ার রহিম মিয়ার কাজ নেই, আজ আর তাঁর রিকশা চলছে না। জামান সাহেব কোট–টাই বেঁধে অফিসে যাচ্ছেন না। আজও সকাল হয়। ঘুম ভাঙে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো আসে, দেখি চারদিক সুনসান, নীরব। আজ আর রিকশার বেলের আওয়াজ শোনা যায় না। ফেরিওয়ালারা আজ ঘুরে বেড়াচ্ছে না। অথচ এই সময় রাস্তাঘাটে বাসের হর্ন, রিকশার বেলের টুংটাং কত আওয়াজই না শুনেছি। বাবার কর্মব্যস্ত সময়টা কাটছে হেয়ালিপনায়। কেমন যেন এক অবসাদ কাজ করছে, চাইলেই বের হতে পারছি না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, টংদোকানের হাসান ভাইয়ের চা—সবকিছু আজ স্মৃতি। পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখি আমাদের শিমুলগাছটা নতুন ডালপালা গজিয়েছে, রাস্তার ধারে নতুন নতুন গাছ হচ্ছে। ভাবি, ইশ্‌! আমাদের প্রকৃতি তার আপন রূপে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেল! এসব ভাবতে ভাবতেই দিন যায় দিন আসে।

আজ আর দূর থেকে মায়ের ফোন পাচ্ছি না। আজ মা পাশেই। কিন্তু, দূরে থাকলে মায়ের ভালোবাসাটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আজ মা–বাবাও যেন একটা দূরত্ব বজায় রাখছেন, দূর থেকে কথা বলছেন। কাছে আসছেন না। আজ আর রুটিন করে ঘুমাতে যাচ্ছি না, সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাসটাও আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তবে রুটিন করে একটা জিনিস দেখা হয়, বেলা আড়াইটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস ব্রিফিং। গত ২৪ ঘণ্টার হিসাব শুরু করা মাত্রই বুক কেঁপে ওঠে! এই বুঝি শুনলাম আজ প্রথমবারের মতো আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি, গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা যায়নি। আশায় থাকি। চোখ টলমল করে ওঠে। কিন্তু প্রতিদিনই বেড়ে চলছে আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা। আজ প্রায় সাড়ে তিন মাস হতে চলল, আমরা জানি না এর শেষ কোথায়।

কবে আবার পুরো পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠবে? কবে আবার সূর্যের আলো দেখতে পাব? কবে আবার বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস করতে পারব আমার জানা নেই। শুনেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরব না। তবে আর কত দিন? আর কত দিন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকব নতুন একটি দিনের আশায়? এসব ভাবতে ভাবতেই মনে হয় যেন সুদিন খুব কাছে। এই কোয়ারেন্টিনে বসে অনেক অজানা ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে।

এই তো আজকের ভোরটা কেন যেন একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে। সূর্যটা যেন আকাশকে একটু একটু করে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। চারদিকে পাখির কলরব, রিকশার টুংটাং আওয়াজ। পাড়ার রিকশাচালক রহিম মিয়া বোধ হয় আজ একটু আগেই উঠেছেন ঘুম থেকে। ওদিকে সবাই কর্মব্যস্ত শহরে বেরিয়ে পড়েছে। বাবাও বেরিয়ে পড়েছেন কাজে। চারদিকে হইহই রব পড়ে গেছে। চারদিকে মানুষের কোলাহল। বাড়িতে কাজ করেন খালাও আজ থেকে আসতে শুরু করেছেন। আমি সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যাই, সকাল সাতটার বাস ধরতে হবে বলে। বের হতেই জামান সাহেবকে দেখতে পেলাম আজ খুব ফুরফুরা মেজাজে কোট–টাই বেঁধে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ছুটে চলেছেন। খেটে খাওয়া মানুষেরা হন্যে হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, কিছুটা আয়ের আশায়। দোকানিরা আজ সকাল থেকেই তাঁদের হরেক রকমের জিনিসের পসরা বিছিয়ে বসে আছেন। দেখলাম, বাবা তাঁর ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছেন একটু প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেবেন বলে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বোধ করলাম, এই যে খেটে খাওয়া মানুষেরা, তাঁদের যেন ঈদের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ আজ! হবেই–বা না কেন, আজ যে আমাদের মুক্তির দিন, আমাদের উল্লাসে ফেটে পড়ার দিন! শাহবাগের মোরে ফুলের দোকানে দোকানে মানুষের ভিড়। এই প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস ব্রিফিং হচ্ছে না। কারণ, দেশে আর কোনো রোগী নেই। চারদিক থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। তবে সূক্ষ্ম একটা জিনিস লক্ষ করলাম, বাসে আজ খুব একটা ভিড় নেই। কে জানে, হয়তো অজানা এক ভয় তখনো খানিকটা রয়ে গিয়েছে। হয়তো নিউ নরমালের ছোঁয়ায় আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ক্লাসে গিয়ে দেখলাম, সবাই ফুরফুরা মেজাজে, সবাই মজা করছে; কিন্তু কেউ কারও কাছে আসছে না, হাতে হাত মেলাচ্ছে না। সবাই কেন যেন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এ রকম অনেক ভাবনা মনের কোণে জন্ম নেয়। মনে শঙ্কা জাগে, যদি আর কখনো আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে না পারি? পারবে তো আমাদের পৃথিবী আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে? তবে আশা রাখি সুদিন খুব কাছেই। আমরাই পারি সুদিন ফিরিয়ে নিয়ে আসতে, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। আমাদের একটু নিয়ম মেনে চলতে হবে। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক। আর নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। তিন থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। আমাদের নিজেদের সচেতনতাই এনে দিতে পারে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি। সেদিন আর কোনো বাধা থাকবে না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা একত্রে দাঁড়াতে পারব। বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে পারব আমরাও পারি। শুধু একটু নিজেদের দায়িত্ববোধ কাঁধে নিয়ে চলতে হবে। সুদিনের আশায় রইলাম। সুদিন আসবেই ইনশা আল্লাহ। তত দিন ভালো থাক আমার দেশের প্রতিটি মানুষ, সুস্থ হয়ে উঠুক আমাদের পৃথিবী।


*শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। [email protected]