সুফিয়া খাতুনকে নিতে আসছে না কেউ

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

সুফিয়া খাতুনের সঠিক বয়সটা কেউ বলতে পারে না। তবে ১০০ বছরের কাছাকাছি বলে সবার অনুমান। ভিটেমাটি কিছু নেই। ছেলে মেয়ে দুজন। তাঁরাও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সংসার চলে কষ্টে। শেষ পর্যন্ত মাকে রাস্তায় ফেলে গেছেন তাঁরা।

সুফিয়া খাতুনকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য বন্দোবস্তও করে দিয়েছে। এখন তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির প্রায় চার মাস পরও সুফিয়াকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেউ নিতে আসছেন না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনূর আলম বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সুফিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। করোনা সংক্রমণকালে বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুনের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘ সময় ভর্তি থাকাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৃদ্ধা সুফিয়া চোখে দেখেন না। কানেও কম শোনেন। তাঁকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ফেলে যাওয়া হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। প্রথমে তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও আপন কাউকে কাছে না পেয়ে চিৎকার শুরু করেন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল ইসলাম খান ঘটনাস্থলে যান। তিনি সুফিয়াকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে উপজেলা প্রশাসন সুফিয়ার ছেলে মোখলেছুর রহমানের খোঁজ পান। তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেকে এনে কথা বলা হয়। তখন তাঁদের পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা জানা যায়।

সুফিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, দাউদকান্দি ইউনিয়নের নছরুদ্দি গ্রামে সুফিয়ার বাড়ি। সুফিয়ার স্বামী কালাই মিয়া প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। পরিবারটির এক শতক জমির ওপরে একটা বসতঘর ছাড়া কিছুই ছিল না। সেটিও এখন আর নেই। একমাত্র ছেলে মোখলেছুর রহমান বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ। তিনি বসতভিটার নিজের অংশটি পাঁচ বছর আগে বিক্রি করে দেন একমাত্র বোন মিনা আক্তারের কাছে। এরপর থেকে মোখলেছুর রহমান বাস করেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি।

মোখলেছুর রহমান বলেন, অভাব-অনটন দেখে নয় বছর আগে তাঁর স্ত্রী সৌদি আরবে চলে গেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তিনি বাসে চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। এমন পরিস্থিতিতে মাকে নিজের কাছে রাখতে পারেননি।

সুফিয়ার একমাত্র মেয়ে মিনাও এখন বয়োবৃদ্ধ। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন উপজেলার গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামে। তিনি পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁর কাছেই এত দিন ছিলেন মা সুফিয়া। দারিদ্র্যের কারণে তিনি তাঁর মাকে মহাসড়কের পাশে ফেলে যান।

মিনা বলেন, বয়স হয়ে যাওয়ায় তিনি নিজে কোনো কাজ করতে পারেন না। তাঁর স্বামী আবদুল মান্নানও বৃদ্ধ। কোনো উপার্জন করতে পারেন না। এক ছেলের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। মাকে কীভাবে রাখবেন?

ইউএনও কামরুল ইসলাম খান বলেন, সুফিয়া খাতুনের ছেলে মোখলেছুর রহমানের তাঁর মায়ের দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও সামর্থ্যের অভাবে নিতে পারছেন না। আবার সুফিয়া খাতুনের কাছের অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। বৃদ্ধার দায়িত্ব নেওয়ার মতো বিশ্বস্ত লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

ইউএনও আরও বলেন, এই মুহূর্তে তাঁকে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বৃদ্ধাশ্রমে দেওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার আগারগাঁও সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর কথা বলা হয়েছে। তবে এর আগে স্বেচ্ছায় কেউ তাঁর দায়িত্ব নিতে চাইলে দেওয়া হবে। সুফিয়া বেগমকে বয়স্ক ভাতার কার্ড ও হুইলচেয়ার দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছায় কেউ দায়িত্ব নিতে চাইলে তাঁকে এক লাখ টাকায় একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।