কাতারপ্রবাসীদের স্মৃতিতে কামরান

বদরউদ্দীন আহমদ কামরান
বদরউদ্দীন আহমদ কামরান

জীবন-জীবিকার তাগিদে আশির দশকে কাতারে পাড়ি জমিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দীন আহমদ কামরান। বেশ কয়েক বছর কাতারে প্রবাসী কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তখন তিনি একটি বিদেশি জিপসাম কোম্পানিতে কাজ করতেন। সে সময় তার সঙ্গে কাজ করেছেন বা তার সঙ্গে ওঠাবসা ছিল এমন অনেকে এখনো আছেন কাতারে।

কাতারে বর্তমানে সোয়া চার লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী রয়েছেন। অবশ্য আশির দশকে সেই সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার মাত্র। ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে কামরান এ দেশে বাংলাদেশি জনসমাজে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

রাজধানী দোহায় কামরানের আশপাশে যেসব বাংলাদেশি প্রবাসী থাকতেন, তাঁদের সবার সঙ্গে তিনি মেলামেশা করতেন। বাংলাদেশি নানা দিবস উপলক্ষে তিনি উদ্যোগ নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তার অবিচল আনুগত্য তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সফলতার চূড়ায়, তিনি হতে পেরেছিলেন সিলেট নগরবাসীর প্রথম নগরপিতা। এমন স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর সেকালের সহকর্মী ও প্রবাসী বন্ধুরা।

পঞ্চাশের দশক থেকে কাতারে বসবাসরত প্রবীণ ব্যবসায়ী বোরহানউদ্দিন শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, আশির দশকে আমি তাঁকে দোহায় বারবার দেখেছি। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। সুক ওয়াকিফে আমার দোকানে কয়েকবার এসেছিলেন। তখন তিনি বয়সে তরুণ। বয়স ৩৫ বছরের আশপাশে ছিল।

কাতারে সে সময় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কর্মরত মামুনুর রশিদের সঙ্গে কামরান বেশি চলাফেরা করতেন। অন্যদের সঙ্গেও তাঁর বেশ ভালো পরিচয় ছিল। মামুন বলেন, ‘দেশে চলে যাওয়ার পরও আমার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। আমার ছেলের বিয়েতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।’

আশির দশকে প্রায় এক যুগ কাতারে ছিলেন আবুল হোসেন। বর্তমানে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করছেন তিনি। সেখান থেকে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, দোহায় তৎকালে সুপরিচিত জায়গা ন্যাশনাল এলাকায় বাজারের সঙ্গে আবদুল্লাহ বিন থানি মহল্লায় থাকতেন কামরান। সেখানে আকাই গোলচত্বরে বসে বিকেলের পর সঙ্গীদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন।

সেই দিনগুলোর কথা মনে করে আবুল হোসেন বলেন, ১৯৮৩ সাল থেকে ৮৫ সাল পর্যন্ত আমরা একই ভবনে পাশাপাশি রুমে ছিলাম। তিনিসহ মোট চারজন প্রবাসী বাংলাদেশি এক রুমে থাকতেন। দিনে কাজ শেষে রুমে ফিরে সবার সঙ্গে বসে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতেন কামরান ভাই। খুব হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিলেন। একজন ভালো মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

আবুল হোসেন বলেন, কামরান ভাই সেকালে কাতারে ইতালীয় একটি কোম্পানিতে জিপসামের কাজ করতেন। তাঁরা এক রুমে মোট চারজন থাকতেন। তাঁর আনুমানিক মাসিক আয় ছিল তখনকার হিসেবে তিন হাজার কাতারি রিয়াল। সেকালে কাতারের এক রিয়ালে বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত টাকা ছিল। আমরা একসঙ্গে অনেক দিন গল্প করেছি। অনেকের নাম হয়তো ভুলে গেছি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

৪২ বছর কাতারে বসবাসের পর বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কে আছেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আশির দশকে আমি যখন কামরানকে দেখেছি, তখন তিনি সুক ওয়াকিফে বিসমিল্লাহ হোটেলের পাশে থাকতেন। আমরা নানা উপলক্ষে একসঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতাম। আমাদের কোম্পানির শ্রমিক ক্যাম্পে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা প্রধান অতিথি করেছিলাম। সম্ভবত ১৯৮৬ বা ’৮৭ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশে চলে যান।

নজরুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কাতারে সেকালে আমরা বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। তিনি সেগুলোতে সব সময় উপস্থিত থাকতেন। তাঁর সঙ্গে সব সময় চলাফেরা করতেন নাজমুল হক, জহির বখশ, শহিদুল হক, এস এম মান্নানসহ আরও অনেকে। প্রায়ই বিকেল-সন্ধ্যার পর আমরা লোদী সাহেবের বাসায় গোপনে রাজনৈতিক শলা পরামর্শ করতাম। রোমেলা এলাকায় টিপু সুলতান রেস্টুরেন্টের পাশে লোদী সাহেবের বাসা ছিল।’

৩৪ বছর ধরে কাতারে বসবাসরত প্রবীণ প্রবাসী মফিকউদ্দীন বলেন, ‘আমি কামরানকে ’৮৪ সালে কাতারে পেয়েছি। তাঁর আপন দুই ভাই আমার রুমে থাকতেন। তাঁদের নাম ছিল আখতার ও এনামউদ্দীন।’

মফিকউদ্দীন বলেন, কামরান ভাই যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেটি কাতারে প্রথম জিপসাম কোম্পানি ছিল। আমি যত দূর জানি, তিনি ৭৯-৮০ সালে কাতারে আসেন। পরে তিনি দেশে ফিরে যান এবং গিয়ে রাজনৈতিক নির্বাচনে অংশ নেন।

কামরানের সেকালের সহকর্মীরা আরও বলেন, মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষত, যার তাঁর সঙ্গে কাতারে ছিলেন, তারা দেশে গেলে নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি তাদের বুকে জড়িয়ে নিতেন, খোঁজখবর রাখতেন।
কামরান আহমদের মৃত্যুতে তাই শোকাহত কাতারপ্রবাসীদের অনেকে। কাতারে বর্তমানে বসবাসরত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী কিংবা সিলেট জেলার প্রবাসীরা শুধু নয়, দলমত-নির্বিশেষে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন সেকালে তাঁর বন্ধু, সুহৃদ ও সহকর্মীরা।

কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বদর উদ্দীন আহমদ কামরান। তৃণমূল থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপারে তিনি আন্তরিক ছিলেন। বিশেষত সিলেটের সবার প্রতি তিনি দরদি এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন। সিলেটে রাজনৈতিক ও নগর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এসব কারণে দেশবাসী তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।’