রোগের চেয়ে ভোগান্তি বড়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
হাসপাতালে কর্মরত সাদা পিপিই পরে লেখক, পাশে তাঁর মেডিকেল সহকারী। পরপর দুজনই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।  ছবি: লেখকের পাঠানো
হাসপাতালে কর্মরত সাদা পিপিই পরে লেখক, পাশে তাঁর মেডিকেল সহকারী। পরপর দুজনই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ছবি: লেখকের পাঠানো

আমি একজন সরকারি চিকিৎসক। যোগ দিয়েছি ৩৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে। কর্মস্থল কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। অন্য অনেক চিকিৎসকের মতো নিজের এলাকায় পোস্টিং না পেলেও আমার অসুবিধা হয়নি। বছরখানেকের মধ্যে উপজেলায় বেশ তাল মিলিয়ে ফেলেছি।

মার্চের শুরুতে হঠাৎ করেই ব্যস্ততা বেড়ে গেল। উপজেলার সবচেয়ে বড় দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করোনাভীতির কারণে চিকিৎসক বসেন না। সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি সেগুলোতেও বসতে শুরু করি। বেশ ব্যস্ততা।

এপ্রিলের ১৮ তারিখ। ঘুম থেকে উঠে শরীরে হালকা ব্যথা ব্যথা ভাব। নাক দিয়ে পানিও পড়ছে। তেমন পাত্তা দিইনি। কুষ্টিয়া শহরে তখনো কোনো করোনা রোগী নেই। নিশ্চিন্তে ডিউটি করে চলেছি।

তিন-চার দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো বেশ কমে এল। ২১ তারিখ হাসপাতালে এক সহকর্মীকে দেখে হুট করেই মনে হলো, স্যাম্পল দিয়েই দেখি না। তখনো বুঝিনি আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

২৩ এপ্রিল সকাল। হাসপাতালে এসে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন—তাঁদের সঙ্গে সভা করলাম। এরপর আউটডোরে বসে রোগী দেখছি। সকাল সাড়ে ১০টায় খবর এল, আমার করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ। খানিক পর প্রচুর ফোন আসতে শুরু করে। এ উপজেলায় আমিই কিনা প্রথম রোগী। আর পুরো কুষ্টিয়া জেলার প্রথম চিকিৎসক রোগী।

সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেব। অফিস থেকে ফিরছি। বাসায় পৌঁছানোর আগেই দেখি, শুধু বাসা নয়, গলি পর্যন্ত লকডাউন। যেসব জায়গায় আমি যেতাম, সেগুলোও। আমার গলিতে অন্তত ২০০ পরিবার থাকে। দুয়েকজন বাদে কেউ আমাকে চেনে না। গত এক মাসে কারও সঙ্গেই আমার করোনা ছড়ানোর মতো যোগাযোগ হয়নি। তারপরও সবাইকে আমার মতো ১৪ দিনের লকডাউনের ভেতর দিয়ে যেতে হলো। লকডাউন করে দেওয়া হলো আমার বাসার কাজের লোক আর দারোয়ানের বাসাও।

শুরু হলো দুই সপ্তাহের এক অন্তহীন অপেক্ষা। এর মধ্যে উপজেলার অসংখ্য মানুষ ভালোবেসে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে বাজার করে দিয়েছেন। কেউ খাবার পাঠিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিদিন খাবার পাঠিয়েছেন আমার বাড়িওয়ালা। শুনতে পেয়েছি, করোনার এই চোখ উল্টে দেওয়া দিনগুলোতে নাকি চিকিৎসকদের বাসা থেকে বের করে দিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা। আমার বাড়িওয়ালা তার এক আশ্চর্য বিপরীত দৃষ্টান্ত। তাঁর মমতায় আমি অভিভূত!

প্রতিদিন অদ্ভুত সব ফোন পেতাম। নিজের নামে অদ্ভুত সব গুজব শুনে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। একদিন শুনলাম, আমার বাসার অন্য সবাই নাকি আক্রান্ত হয়ে গেছেন। আরেক দিন শুনি, আমি নাকি মারা গেছি। এলাকাবাসী কাউকে একঘরে করে রাখে তো কাউকে হাসপাতালে বা বাজারে যেতে দেয় না। করোনা থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব, কিন্তু ভোগান্তি থেকে? একজন মেডিকেল সহকারী সুস্থ হওয়ার পরও এলাকাবাসী তাঁকে ঈদের জামাতে দাঁড়াতে দেননি। এখানে যতজন করোনা রোগীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, সবার অভিজ্ঞতা কমবেশি একই রকম। তাঁদের পরিবার বা পাড়া-প্রতিবেশীদের অভিজ্ঞতাও কম বিড়ম্বনার নয়।