স্কুলে না যাওয়া দিনগুলো

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মিসরে যাওয়ার আগেও কিছু বোঝা যায়নি। এ বছর জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ। মা, বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বের হলাম মিসর ভ্রমণে। তখনো এই করোনাভাইরাসের ব্যাপারে জানতাম না। দেশের সবকিছু খোলা। দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, রাস্তাঘাট সব জায়গাতেই মানুষের চলাচল। ১৭ জানুয়ারি আমরা দেশে ফিরলাম। এর ১০-১৫ দিন পর করোনার কথা অল্প অল্প করে ছড়িয়ে পড়ে। তবে মানুষের মধ্যে তেমন আতঙ্ক দেখিনি। এই ভাইরাস ভারতের দিকে আসার পর আতঙ্ক ছড়াতে থাকে।

১৭ ফেব্রুয়ারি আমার জ্বর-ঠান্ডা-কাশি শুরু হয়। পরের দিন মায়ের ঠান্ডা-কাশি-জ্বর এবং এর পরের দিন ভাইয়ের। তবে সবাই তিন-চার দিনের মধ্যে ভালো হয়ে গেলাম। এর মধ্যে আবার বাবা ব্যস্ত হয়ে গেলেন বাসা রং করার জন্য। মা গাড়িতে করে আমাকে আর ভাইকে দাদার বাসায় রেখে এলেন।

১১ মার্চ। বাসায় রং করার কারণে কিছুদিন ধরে দাদার বাসাতেই ছিলাম। স্কুল খোলা; কিন্তু আমাদের কে আনা-নেওয়া করবে; তাই যাওয়া বারণ হয়ে গেল। দাদার বাসায় স্কুলের বই পড়ে, দাদার গল্প শুনে, দাদির হাতের পিঠা খেয়ে আর ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে দিন যায়। স্কুলে আবার অনুষ্ঠান ছিল ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের। সেটা হবে কি না, ভাবছিলাম। কারণ, বাংলাদেশে ৮ মার্চ করোনা রোগী পাওয়া গিয়েছে। আর স্কুলে যেতে আমার বন্ধুরাও ভয় পাচ্ছিল।

১৬ মার্চ সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে খাবার টেবিলে বসতেই বাবার ফোন এল। ফোনে জানতে পারি, কাল থেকে দেশের সব স্কুল বন্ধ। আবার খুলবে ১ এপ্রিল। খবরটা দাদা-দাদিকে জানাই। এরপর নাশতা করতে বসি। নাশতা শেষে কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসলাম। এরপর বিভিন্ন দেশের খবরাখবর দেখলাম ইন্টারনেটে। খানিক বাদে মা আবার ফোন দিলেন। তিনি আমাদের বাসায় নিয়ে যাবেন। একটু অবাকই হলাম। কারণ, বাসায় রঙের কাজ শেষ হয়নি। কোনোরকম একটা ঘর খালি। বাকি ঘরগুলো এলোমেলো, ধুলায় ভরা। মায়ের ফোনের পর ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। সন্ধ্যায় নাশতা করার পর গাড়ি এল। আমরা বাসায় পৌঁছালাম। রাতটা পার হয়। পরদিন সকালে শুরু হয় ঘর গোছানো। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন আর রঙের কাজ হবে না। তাই একটানা সাত দিন ধরে ঝাটাপাটা করে বাসা পরিষ্কার করে ফেললাম।

বাসায় বসে পড়ি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলাম ২০২০ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকমতো ক্লাস করতে পারিনি। মিসর থেকে ফিরে কিছুদিন স্কুলে যাইনি। এরপর ঠান্ডা-জ্বরের কারণেও কয়েক দিন স্কুলে যাওয়া হয়নি। এরপর তো স্কুলে যেতে না যেতে করোনার বন্ধ শুরু হলো। এদিকে আমরা এই ছুটিতে নানা রকম রুটিন তৈরি করেছি। কখন কী করতে হবে সেই রুটিন, কোন বেলায় কী খেতে হবে সেই রুটিন, কে কতটা ভালো আর খারাপ কাজ করল, সেই তালিকা... এ রকম অন্তত সাতটা রুটিন আর তালিকা ঝুলছে আমাদের ডাইনিং-ড্রয়িং স্পেসে।

প্রতিদিন ভোরে উঠে ছাদে গিয়ে ব্যায়াম করি। এরপর গোসল, নাশতা সেরে পড়তে বসি। পড়া শেষ করে কম্পিউটারে গেম খেলি। দুপুরে খেয়ে টেলিভিশন দেখি। বিকালে ছবি আঁকি। এখন অনলাইনে আর্ট ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় খেয়ে পড়তে বসি। সে আরেক কাহিনি। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ভয়ে বাবা বিশাল এক মশারি বানিয়েছিলেন গত বছর। ডাইনিং স্পেসে ওই মশারি টাঙিয়ে পড়তে হয়। পড়া শেষ হলে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করি। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার কোনো রুটিন নেই। ওই দুই দিন নিজেদের শরীরের অতিরিক্ত যত্ন আর বাসা পরিষ্কার করার কাজ। মাঝেমধ্যে লুডু খেলা হচ্ছে। মুভি দেখা চলছে। তবে কোনো কোনো দিন রুটিন বলে কিছুই থাকছে না। আর কবে সপ্তাহ শুরু হয়ে শেষ হয়, বুঝতেই পারি না।

* শিক্ষার্থী, রূপনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। [email protected]