নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনলেই অক্সিজেন নিয়ে ছুটছেন তাঁরা

সিফাত রেহনা নামের এই নারীর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। খবর পেয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তাঁর বাসায় যান কাউন্সিলর মোরশেদ আলমের স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের আলফালাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায়।  ছবি: সংগৃহীত
সিফাত রেহনা নামের এই নারীর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। খবর পেয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তাঁর বাসায় যান কাউন্সিলর মোরশেদ আলমের স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের আলফালাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত

রাত ৩টা বেজে ৫৫ মিনিট। বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন নেজাম উদ্দিন। এ সময় বেজে উঠল ফোন। তড়িঘড়ি করে ধরতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলে কান্নামেশানো আর্তি, ‌‘আমার ভাইয়ের খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দ্রুত অক্সিজেন দরকার। একটু যদি আসতেন।’ এরপর বিছানা থেকে উঠেই অক্সিজেন নিয়ে ছুটলেন রোগীর বাড়িতে। ১২ ঘণ্টা ধরে অক্সিজেন সেবা দেওয়ার পর রোগী আবুল হোসেন এখন কিছুটা সুস্থ। যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই ব্যক্তি।

গত রোববার দিবাগত রাতে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর মুখে অক্সিজেন তুলে দেওয়ার এই ঘটনাটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চিকনদণ্ডী এলাকার। আর এই গ্রামেরই সন্তান পরিবহন ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন।

শুধু নেজাম উদ্দিন নন, তাঁর মতো চট্টগ্রামের আরও বেশ কয়েকজন তরুণও এগিয়ে এসেছেন নিশ্বাস বন্ধের প্রহর গুনতে থাকা রোগীদের পাশে। আছেন জনপ্রতিনিধি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। এখন শ্বাসকষ্টের রোগী শুনলেই তাড়িয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রাম নগরের অনেক হাসপাতাল। আবার অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি ও রিফিল করার দোকানগুলোও এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। তাই অক্সিজেনের অভাবে কারও মৃত্যু হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সেই, কেউবা নিথর হয়ে পড়ছেন বাসাতেই। এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে এই অচেনা মানুষেরাই যেন হয়ে উঠেছেন রোগীদের আশা-ভরসা।

প্রথমে বলা যাক নেজাম উদ্দিনের কথা। ১১ জুন থেকে শ্বাসকষ্টের রোগীদের পাশে দাঁড়াতে তিনি কেনেন নয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিমিটার। নিজের ইউনিয়ন থেকে যে সেবা কার্যক্রম চালু করেছিলেন, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো হাটহাজারীতে। এ পর্যন্ত ১৪ জন রোগীকে অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন তিনি।

শোলকবহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ মোরশেদ আলম তো ৩টি অ্যাম্বুলেন্স আর ১০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার জন্য পরিপূর্ণ একটি দলই গড়ে তুলেছেন। যে দলে আছেন চিকিৎসক থেকে অপারেটর। রোগীদের অক্সিজেন সেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাজটিও করে যাচ্ছেন তাঁরা। হটলাইনে ফোন করলেই সরাসরি রোগীর বাসার সামনে হাজির হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। কখনো কখনো রোগী আর স্বজনদের ভরসা দেওয়ার জন্য ছুটছেন মোরশেদ আলম নিজেও।

মোরশেদ আলম বলেন, ‘সামান্য অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাবে, তা হতে পারে না। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটাই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত সুযোগ। তাই ৩টি অ্যাম্বুলেন্স ও ১৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আমার কার্যক্রম শুরু করেছি। পাশাপাশি রোগীদের যেন প্রাথমিক চিকিৎসাটা দিতে পারেন, সে জন্য আমার দলে রেখেছি দুজন চিকিৎসক। এ পর্যন্ত ২৭ জন রোগীকে অক্সিজেন সেবা এবং ১৩ জনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি।’

ঢাকা ও চট্টগ্রামের অসহায় রোগীদের কাছে অক্সিজেন সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মানবিক প্রতিষ্ঠান পে ইট ফরোয়ার্ড এবং মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনও। ইতিমধ্যে ১০০টি সিলিন্ডার নিয়ে সেবা দেওয়া শুরু করেছেন পে ইট ফরোয়ার্ডের কর্মীদের একজন ইকবাল তানজির। নিষ্ঠা ফাউন্ডেশন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানও রোগীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। ৯ জুন কার্যক্রম শুরুর পর প্রতিদিনই রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিচ্ছেন বলে জানান ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নুর হোসেন।

সৈয়দ ইকরামুল হক, আহমেদ নিলয় ও সাইয়েদ আরমান—এই তিন বন্ধুর উদ্যোগটা আবার অন্য রকম। যাঁদের সিলিন্ডার আছে, তাঁদের অক্সিজেন ভরে দিচ্ছেন তাঁরা। সীতাকুণ্ডের বার আউলিয়া এলাকায় এই তিন তরুণের ‘মাস্টার অক্সিজেন’ নামের একটি প্ল্যান্ট আছে। মানবসেবা করতে এই প্ল্যান্টকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা। এখন তাঁদের সেই প্ল্যান্টে প্রতিদিন অসহায় মানুষেরা ছুটছেন সিলিন্ডার নিয়ে। উদ্যোক্তাদের একজন সৈয়দ ইকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ৬ জুন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেন। এ পর্যন্ত তাঁরা ৩৬১টি সিলিন্ডার রিফিল করে দিয়েছেন।

এই মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলছেন না সেবাগ্রহীতাদের স্বজনেরা। ফেসবুকে সেই প্রশংসার কথা লিখছেন কেউ কেউ। তাঁদের একজন সাকলাইন খুরশীদ লেখেন, ‘মুনাফালোভীরা যখন অসহায়কে পুঁজি করে অতি লাভের মোহে অন্ধ, তখন যেন এই তরুণেরাই আমাদের আলো দেখায়।’