স্যালুট, বীর স্বাস্থ্যসুহৃদদের

এত বেশিসংখ্যক চিকিৎসক মারা গেলেন কোভিড–১৯-এ আক্রান্ত হয়ে! এত বেশিসংখ্যক চিকিৎসক কোভিডে আক্রান্ত হলেন! বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে যে শূন্যতা এরই মধ্যে নেমে এসেছে, তা পূরণ হবে কী করে!

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ১৭ জুন পর্যন্ত ৪১ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। ৫ জন মারা গেছেন করোনার লক্ষণ নিয়ে। এবং এই মানুষগুলো সংখ্যা নয়।

ফেসবুকে মাস দুয়েক আগে লিখেছিলেন ডা. মাহমুদ মনোয়ার, ‘একজনের মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি। যখন মৃত্যুসংখ্যা লাখ ছাড়ায়, তখন তা শুধুই পরিসংখ্যান।’ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদ মনোয়ার এখন নিজেই শোকসংবাদের শিরোনাম। ১২ জুন ২০২০-এ নিজ হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে।

আমার ভাই ডাক্তার, ভাবি ডাক্তার, বোন ডাক্তার, ভগ্নিপতি ডাক্তার, ভায়রা ডাক্তার, ভাতিজা-ভাতিজি ডাক্তার। একজন করে চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর পাই, আমার হাত–পা শীতল হয়ে আসে। কতগুলো পরিবারে আজ নেমে এসেছে স্বজন হারানোর শোকের আঁধার। কত সন্তান হলো বাবা-হারা, মা-হারা, কত মা সন্তানহারা হলেন!

আমাদের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের কতজনকে আমরা হারিয়ে ফেললাম এরই মধ্যে! প্রফেসর এন আই খানের সুনাম আমি শুনে আসছি সেই রংপুর থেকে। রংপুর মেডিকেল কলেজে শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। আবার পুরো জেলায় তাঁর সুখ্যাতি ছিল চিকিৎসক হিসেবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাঁর ছাত্র আব্দুন নূর তুষার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এন আই খান স্যার একদিন কথায় কথায় বললেন, ভালো শিক্ষক তার চেয়েও ভালো ছাত্র বানায়। কারণ, মরতে হবে তো ছাত্রের হাতের ওপরে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধু দেশের না, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়, এমন একটা জায়গা হলো তাঁর ঢাকা মেডিকেল কলেজ...স্যার ঢাকা মেডিকেলেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তিনি তাঁর সবচেয়ে গর্বের ও পছন্দের জায়গাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন শেষ দিনটিতেও।’

করোনায় মারা যাচ্ছেন আমাদের সেরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। আইসিইউ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রথম মারা যান ডা. আবদুর রহমান। গত ২৬ মে করোনার উপসর্গ নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনটা হাসপাতালের আইসিইউর প্রধানেরা মারা গেলেন কোভিডে। ৭ জুন স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন, ৯ জুন ইমপালস হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. জলিলুর রহমান এবং ১৩ জুন রাতে বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান ডা. সাজ্জাদ হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মির্জা নাজিম উদ্দিনের মুখটা আমি ভুলতে পারি না। আমাদের এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে কিছুদিন ছিলেন তাঁর আইসিইউতে। তিনি রোজ আমাদের ব্রিফিং করতেন। তাঁর উদ্বেগাকুল মুখ, তাঁর বিষাদমাখা হাসি আমার স্মৃতিতে স্থায়ী আছে। ডা. গোলাম কিবরিয়া, ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, ডা. ওয়াহিদুজ্জামান আকন্দ, ডা. হাবিবুর রহমান, ডা. রাজিয়া সুলতানা, ডা. মো. মনিরুজ্জামানের মতো জ্যেষ্ঠ গুণী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের হারানোর ক্ষতি এ দেশ সামলাবে কী করে?

শুধু কি প্রবীণ চিকিৎসকেরা? মারা যাচ্ছেন তরুণ চিকিৎসকেরাও। ফেসবুক খুললে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়।

প্রথম আলো ১৫ এপ্রিল ২০২০ লিখেছিল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপক মারা গেছেন। সেই শুরু। অকালপ্রয়াত এই ডা. মঈন উদ্দীনের চেহারাটা এত চেনা চেনা লাগে!

গতকাল এই লেখা যখন লিখছি, তখনই প্রথম আলো অনলাইনের খবর, করোনার উপসর্গে চট্টগ্রামে মারা গেলেন আরেক চিকিৎসক। নাম ডা. নুরুল হক (৪৩)। দিনাজপুরে মারা গেছেন ডা. আব্দুল আহাদ। ঢাকায় মারা গেছেন ডা. মো. আশরাফুজ্জামান।
এত দুঃসংবাদ কী করে নিই?
প্রথম আলোর ১৭ জুন ২০২০-এর দুপুরের খবর, ‘এ পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ১১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৩১ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, সারা দেশে ১ হাজার ১৬০ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ মোট ৩ হাজার ৫০২ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।’

প্রথম আলো লিখেছে, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে বেশি। দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ৫২০ জন। মোট আক্রান্তের ৪ শতাংশই হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী। আন্তর্জাতিক নার্সেস কাউন্সিলের হিসাবে বৈশ্বিকভাবে এই হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ।’ (চিকিৎসকদের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে, প্রথম আলো, ১৫ জুন) আব্দুন নূর তুষার ১২ জুন ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ভারত এত বড় দেশ। অথচ সেখানে ডাক্তার, নার্স প্যারামেডিকসহ মোট আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম কেন?’
পিপিইর অভাব? পিপিইর মানে ত্রুটি? পিপিই ব্যবহারে প্রশিক্ষণের অভাব?

১৫ জুন শিশির মোড়লের প্রতিবেদনে প্রথম আলো লিখেছে, প্রায় দেড় মাস আগে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও নাগরিক সংগঠন হেলথ ওয়াচ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) নিয়ে জরিপ করেছিল। সেই জরিপে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ বলেছিলেন, তাঁরা পিপিই পাননি। আরও বড় অংশ বলেছিলেন, তাঁরা কোনো প্রশিক্ষণও পাননি। পিপিই ও প্রশিক্ষণ—দুটোই সংক্রমণ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।

পিপিইর মান ও সরবরাহ নিয়ে অভিযোগ শুরু থেকেই ছিল। তবে অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন বিএমএর মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন পিপিই নিয়ে কোনো সমস্যা বা অভিযোগ নেই। তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইসমত আরা। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ের সব হাসপাতালে নার্সরা পিপিই পাচ্ছেন না। এ ছাড়া নার্সদের বড় অংশ পিপিইর ব্যবহার বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। (প্রথম আলো, ১৫ জুন)
প্রবীণ ডাক্তার হাসপাতালে যাচ্ছেন। ফিরে এসে আলাদা ঘরে তাঁদের ঘুমোতে হচ্ছে। বাড়ির অন্যদের যেন তিনি নিজে সংক্রমিত না করেন। তরুণ চিকিৎসক ফিরে আসছেন হাসপাতাল থেকে, তাঁর শিশুসন্তানটি দৌড়ে আসছে, তিনি তাকে স্পর্শ করতে পারছেন না!

প্রতিদিন এমনি করে, নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে আমাদের ডাক্তাররা, নার্সরা, স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালে, মানবতার সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ একেকজন বীর!

আজ এত এত চিকিৎসককে হারিয়ে, এত এত চিকিৎসককে করোনাক্রান্ত হতে দেখে আমরা গভীর বেদনায় ভাষা হারিয়ে ফেলছি।

ডা. মোহিত কামাল তাঁর ফেসবুকে ১২ জুন ২০২০ লিখেছেন, ‘জাতির বীর স্বাস্থ্যবন্ধুরা, তোমাদের মহান কীর্তিগাথা ইতিহাসের স্বর্ণচূড়ায় তুলে রাখব আমরা, সমগ্র জাতি। দেশবাসীর হৃদয়ের গহনে মানবিক উচ্চতার আসন তোমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।’

মোহিত কামালের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি, আমাদের চিকিৎসকেরা, আমাদের চিকিৎসাকর্মীরা বীরযোদ্ধা। আমরা চোখে অশ্রু, হাতে ফুল আর হৃদয়ে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা নিয়ে আপনাদের জানাই অভিবাদন। স্যালুট, হে বীর স্বাস্থ্যসুহৃদেরা।

পুলিশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকদের প্রতি প্রথম আলোর শ্রদ্ধা। তাঁদের নিয়ে বিশেষ আয়োজন দেখুন আগামীকাল।