সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে ২০ বাবার মামলা

লিবিয়া থেকে মাসখানেক আগে ফরিদপুরের কবির শেখের মুঠোফোনে একটি ভয়েস মেইল আসে। মেইলটিতে অডিও রেকর্ড ছিল। তাতে ছেলের কান্না আর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে যান কবির শেখ। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একই ধরনের ভয়েস মেইল পান মাদারীপুরের তরিক মোল্লাও। ছেলের আকুতি শোনার পর মানব পাচারকারীদের হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন ১২ লাখ টাকা। কিন্তু দুজনেই কেউই তাঁদের ছেলেকে ফিরে পাননি। আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার জিম্মি অবস্থায় পাচারকারীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা।

 শুধু এই দুই বাবাই নন এমন আরও ১৮ জন পাচারকারী চক্রের হাতে নিজের সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে মামলা করেছেন। গত ২৮ মে লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে জিম্মি অবস্থায় গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হন। যে ২০ জন মামলা করেছেন তাঁদের সবার ছেলে ওই ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এরপর দেশে থাকা মানব পাচারকারীদের ধরতে ১ জুন থেকে সারা দেশে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পাশাপাশি, গোয়েন্দা পুলিশ, র‍্যাব, সিআইডি ও পিবিআই বিশেষ অভিযানে যুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৬টি মামলা হয়েছে, তার ২০টি করেছে নিহতদের বাবা বা স্বজন। বাকি ছয়টি মামলা করেছে র‍্যাব, সিআইডি ও ডিবি। এসব মামলায় ৩০০ পাচারকারীকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে পুলিশের তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী আছেন এক হাজার ৬২ জন। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা আছে। তালিকায় থাকা পাচারকারীদের মধ্যে ৪৭০ জনের বহুদেশীয় নেটওয়ার্ক আছে। তাঁদের মধ্যে ঢাকায় অবস্থান করেন ঢাকায় তালিকাভুক্ত ৯৪ জন। তাঁদের ধরতেই পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, মানব পাচারকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাঁদের ধরতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এ ব্যাপারে সব পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মানব পাচার মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব চক্রে নারী সদস্যও আছেন। দালাল চক্র ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করে। এরপর চক্রের ফাঁদে পা দেওয়া তরুণদের ঢাকা থেকে দুবাই নিয়ে যায়। সেখান থেকে নেওয়া হয় জর্ডান বা লিবিয়ায়। সেই ঠিকানায় পৌঁছানোর পর জিম্মি করে টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতন করা হয়।

>

লিবিয়ায় গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পর দেশে ২৬ মামলা। আসামি ৩০০ জন।

লিবিয়ায় গুলিতে নিহতমাদারীপুরের আয়নাল মোল্লার বাবা তরিক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য একটি দালাল চক্রের সঙ্গে ১২ লাখ টাকার চুক্তি করেন তিনি। এর মধ্যে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নগদ দেন। কথা হয় ইতালি পৌঁছানোর পর বাকি টাকা দেওয়া হবে। ছেলে দেশ ছাড়ার কিছুদিন পর তাঁর মুঠোফোনে একটি ভয়েস মেইল আসে। তাতে ছেলের আর্তনাদ এবং ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শোনা যায়।

তরিক মোল্লা জানান, ওই ভয়েস মেইল পাওয়ার এক দিন পর পাচারকারী চক্রের এক সদস্য এসে জানান, আরও ১২ লাখ টাকা না দিলে ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। তিনি জমি বিক্রি করে সেই টাকা তুলে দেন পাচারকারীদের হাতে। এরপর ২৮ মে জানতে পারেন লিবিয়ার মিজদাহ শহরে তাঁর ছেলে অপহরণকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।

সন্তান হারানো আরেক বাবা ফরিদপুরের কবির শেখ জানান, তাঁর ছেলে কামরুল শেখকে ভারত, দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে যান পাচারকারীরা। সেখানে জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। এ টাকা তিনি কীভাবে দেবেন তাই নিয়ে চিন্তায় পড়েন। তিনি বলেন, যেদিন ছেলেকে গুলি করা হয়েছিল তার আগের দিন দুপুরে এসেও টাকা দাবি করেছিলেন পাচারকারীরা।

মানব পাচারের অভিযোগে সিআইডির উপপরিদর্শক কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ৪ জুন ৩৪ জনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করেন। এই মামলায় বনানীর বেঙ্গল টাইগার ওভারসিস ও রুজভেল্ট ট্রাভেলস নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়। পুলিশের অভিযানের পর প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক-কর্মচারীরা গা ঢাকা দেন। পুলিশের তদন্ত বেরিয়ে আসে দুটি প্রতিষ্ঠানের ছায়ায় গড়ে ওঠা একটি আন্তর্জাতিক চক্র শত শত যুবকে বিদেশে পাচার করেছে। এই চক্রের অন্যতম হোতা জুলহাস শেখকে গত ৮ জুন মাদারীপুর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে নিহতের স্বজনেরা মাদারীপুরের রাজৈর এবং গোপালগঞ্জের মকসুদ থানায় তিনটি মামলা করেছেন।

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, জুলহাস সরদার মানব পাচারকারী আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্য।

পুলিশ জানায়, জুলহাসের এক সহযোগী আবদুর রহমান মিসরে, আরেক সহযোগী আবদুল্লাহ লিবিয়ায় এবং সাদ্দাম হোসেন নামের আরেক সহযোগী থাকেন দুবাইতে। বাংলাদেশে তাঁদের চক্রের সদস্য দুই শ থেকে আড়াই শ জন।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তালিকায় দেখা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ১২ বছরে ১১ হাজার ৪০০ জন পাচারের ঘটনায় ৬ হাজার ১৩৪টি মামলা রয়েছে। এ সময় ২৩৩টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। বিচার শেষ হওয়া মামলায় ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ২৯৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিচারাধীন আছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। এসব মামলার মধ্যে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে হয়েছে ১০৬টি মামলা। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মামলা ছিল ৬৮৫টি, আর ২০১৮ সালে ছিল ৫৬১টি। আর ২০১৭ সালে মানব পাচারের মামলা ছিল ৭৭৮টি।

মানব পাচারকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযানের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় শুরুতে বেশ হইচই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতে সব থেমে যায়। মানব পাচারে ক্ষেত্রে সেটা হলে জাতি খুব হতাশ হবে। মানব পাচারের মামলার দিকেও বেশি জোর দিতে হবে। সরকারের উচিত জঙ্গি দমনের মতো গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়টির সমাধানে আসা।