অ্যান্টিবডি শনাক্তে ৭০% কার্যকর

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট কোভিড–১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির অ্যান্টিবডি শনাক্তে ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষক দল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে এ কথা বলেছে। গতকাল বুধবার বিএসএমএমইউ আনুষ্ঠানিকভাবে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং সংক্ষিপ্তসার গণমাধ্যমে পাঠায়।

বিএসএমএমইউর গবেষক দল বলেছে, এই কিট কোভিড প্লাজমা বিতরণ, কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) সমাপ্তির সময় নির্ধারণ এবং লকডাউন তুলে নেওয়ার ব্যাপারে ব্যবহার করা যাবে। তবে কোভিড–১৯ রোগের উপসর্গ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের রোগ শনাক্তকরণে এই কিট কার্যকর নয়। অর্থাৎ এই কিট দিয়ে অ্যান্টিজেন শনাক্ত করা যাবে না।

কিট উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, লালার নমুনা নিয়ে পরীক্ষায় জটিলতা দেখা দেওয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অ্যান্টিজেন শনাক্তের বিষয় থেকে পিছিয়ে আসে। তাই রোগ শনাক্তকরণের বিষয়টি আপাতত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিজেন শনাক্তের কিট তৈরির কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

চারজন বিজ্ঞানী ও গবেষক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কিট উদ্ভাবন করেছেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধান গবেষক বিজন কুমার শীল। গতকাল বিকেলে বিজন কুমার শীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ গণস্বাস্থ্যের কিট বিষয়ে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠায়নি। সেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা আমাদের ব্যাখ্যা দেব। আগামীতে আমরা কী করতে যাচ্ছি, তা–ও দেশবাসীকে জানাব।’

তবে বিজ্ঞানী দলের অন্য সদস্য ফিরোজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক মাসের বেশি সময় আগে কিট তৈরি করে কার্যকারিতা দেখার জন্য জমা দেওয়া হয়েছিল। এই সময় আমরাও বসে ছিলাম না। আমরা কিটের উন্নয়নে কাজ করে গেছি। এর কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশে উন্নীত করেছি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএসএমএমইউর মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশের পর গণস্বাস্থ্যের কিটবিষয়ক বিতর্ক বা আলোচনা শেষ হলো না। এটা আরও কিছুদিন চলবে। বিএসএমএমইউর একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘দেশি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত। এই কিটের উন্নয়ন ঘটাতে বা কার্যকারিতা বাড়াতে বিজ্ঞানী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে সহায়তা করা উচিত। পাশাপাশি কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণে এই কিট ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২৯ এপ্রিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট মূল্যায়নের জন্য বিএসএমএমইউকে কনট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) হিসেবে নিয়োগ দেয়। বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক শাহীনা তাবাসসুমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি গবেষক দল তৈরি করে তাদের কিট মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়। গবেষক দলের মূল কাজ ছিল দ্রুত অ্যান্টিবডি শনাক্তে এই কিটের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা। গবেষক দল ৫০৯ জন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে কিটের কার্যকারিতা সম্পকে মতামত দিয়েছে। বিএসএমএমইউ ২০০টি কিট পেয়েছিল।

কিট কী কাজে লাগবে

বিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু রোগে আক্রান্ত হলে ব্যক্তির শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি হচ্ছে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধকারী প্রোটিন জাতীয় পদার্থ। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেও নির্দিষ্ট সময় পর অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পর ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া শুরু হয়। অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া ব্যক্তির আবার একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। একবার বসন্তে আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার এতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একই ব্যক্তির দ্বিতীয়বার করোনা হবে না, এটা বলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য এখনো হাতে নেই।

করোনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির প্লাজমা অন্য রোগীকে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, তাতে অ্যান্টিবডি আছে। বাস্তবে অ্যান্টিবডি আছে কি না, তা গণস্বাস্থ্যের কিট ব্যবহার করে জানা যাবে। ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পাঁচ মিনিটে ফলাফল জানা যাবে।

জনগোষ্ঠীতে কী পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, সেই গবেষণার কাজেও এই কিট ব্যবহার করা যাবে। বিএসএমএমইউ বলেছে, রোগের ব্যাপ্তি বোঝার জন্য এই কিট ব্যবহার করা যাবে। আক্রান্ত হওয়া ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭০ জনের অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, এই কিট ব্যবহার করে জানা যাবে কত শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে এবং কত শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনা প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এই তথ্য টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য টিকা দেওয়া হয়। আগে থাকতেই যদি জানা যায়, কার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আছে বা শরীরে অ্যান্টিবডি আছে, তাহলে টিকার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।

আরও কাজ বাকি

বিএসএমএমইউ তাদের মূল্যায়নে বলেছে, গণস্বাস্থ্যের কিট দিয়ে কোভিড রোগে আক্রান্ত কি না, তা শনাক্ত করা যাবে না। তবে শনাক্ত করার ব্যাপারে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা।

কোনো ব্যক্তি কোনো রোগে আক্রান্ত কি না, তা জানা যায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে। অ্যান্টিজেন হচ্ছে ভাইরাস কোষের কোনো একটি অংশ। লালার নমুনা নিয়ে অ্যান্টিজেন শনাক্ত করা হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রে করোনা নির্ণয় ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় একটি ‘ইমিউনেসে কিট’ (একের ভেতরে দুয়ের বেশি বিষয় পরীক্ষা) তৈরির কথা বলেছিল। এর মধ্যেই ছিল দুটি সম্পূর্ণ আলাদা কিটের মাধ্যমে অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি শনাক্তের ধারণা।সেই অনুযায়ী তারা প্রস্তাব দিয়েছিল বিএসএমএমইউর কাছে। পরে লালার নমুনা নিয়ে পরীক্ষায় জটিলতা দেখা দেওয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণের বিষয়টি প্রত্যাহার করে নেয়।

এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গবেষণার ফলাফল খুব শিগগির লিখিতভাবে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানিয়ে দেব।’