করোনা রোগীর সেবা দিতে চট্টগ্রাম নগরে হচ্ছে দুটি হাসপাতাল, মোট শয্যা ১২০টি

আপনাদের কাছে দোহাই লাগে। পারলে একটি অক্সিজেন ব্যবস্থা করে দেন। আমার মায়ের অবস্থা তেমন ভালো না। শ্বাস নিতে পারছেন না। ওনাকে চট্টগ্রামের ন্যাশনাল হসপিটালে ভর্তি করেছি। কিন্তু অক্সিজেন নেই।'
গত বুধবার রাতে এমন আকুতি জানিয়ে সহযোগিতার জন্য ফেসবুকে পোস্ট দেন আসমা উল হুসনা। আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের এক স্বেচ্ছাসেবীর চোখে পড়ে এই পোস্ট। তিনি তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করেন ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরা দ্রুত অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের উদ্যোগ নেন। স্ট্যাটাসের ১৫ মিনিটের মাথায় অক্সিজেন পেয়ে যান আসমা।
করোনা সংক্রমণের পর থেকে এভাবে সেবা দিয়ে আসছে আল মানাহিল ফাউন্ডেশন। এখন তারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য চালু করতে যাচ্ছে হাসপাতাল। চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের ফইল্যাতল্লী বাজারের ফুল চৌধুরী পাড়ায় তৈরি হচ্ছে ৭০ শয্যার নার্চার হাসপাতাল। এখন চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতির কাজ। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভর্তি শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উদ্যোক্তারা।

অসুস্থ ব্যক্তিদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, অক্সিজেন সরবরাহ কিংবা করোনায় বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মৃত ব্যক্তির দাফন-জানাজায়ও যুক্ত আছে এই ফাউন্ডেশন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গার কাঠগড় এলাকায় একজন চিকিৎসকের উদ্যোগে করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে ৫০ শয্যার হাসপাতাল চালু হতে যাচ্ছে। সেখানে প্রাথমিক সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে।
রোগীর দুর্ভোগ দেখে হাসপাতাল চালুর উদ্যোগ
করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ থাকা ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অন্যরা যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন সেবার দূত হয়ে হাজির হন আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে থাকে রোগীদের। হাসপাতালে পৌঁছে দিতে গিয়ে রোগীদের নানা দুর্ভোগ দেখতে পান ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। কোনো হাসপাতাল রোগীদের ভর্তি করাচ্ছে না। কোথাও চিকিৎসার মাঝপথে রোগীদের বের করে দেওয়া হচ্ছিল। আবার কোথাও গিয়ে দেখতে পান, হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী। ফলে রোগী নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে অনেক সময়।

রোগীদের এসব কষ্ট দেখে করোনা হাসপাতাল চালুর পরিকল্পনা মাথায় আসে বলে জানান ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে–হাসপাতালে রোগীদের এসব দুর্ভোগ আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই কিছু একটা করার চিন্তা থেকে হাসপাতাল চালুর বিষয়টি মাথায় আসে। এই চিন্তা থেকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি অহিদ সিরাজের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এরপর কাজ শুরু হয়। এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে রোগী ভর্তি করাতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।
ফরিদ উদ্দিন জানান, আমেরিকা প্রবাসী নাজনীন বাকী জায়গাটি দান করেছেন। ওখানে এক সময় একটি হাসপাতাল ছিল। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। করোনা শেষ হলে হাসপাতালটিতে প্রসূতি মায়েদের সেবা দেওয়া হবে। পাশাপাশি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হবে। ভবিষ্যতে এটি হবে একটি মডেল হাসপাতাল।
ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে শয্যা স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য হাই ফ্লো অক্সিজেন মেশিনও স্থাপন করা হচ্ছে। বন্ধু ও শুভকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে এই হাসপাতালের ব্যয় নির্বাহ করা হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
১৯৯৮ সালে জনসেবার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের নানুপুর জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়ার তৎকালীন প্রধান পরিচালক মাওলানা জমির উদ্দিন (রহ.) আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামের এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। বাবার স্মৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন তাঁরই সাত সন্তান।

চিকিৎসকের উদ্যোগ
চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড। এসব এলাকায় রয়েছে বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আছে কয়েক শ কারখানা। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকাগুলোতে চিকিৎসাসেবার জন্য নেই কোনো হাসপাতাল। ফলে ওই এলাকার মানুষদের আসতে হয় আগ্রাবাদ ও জিইসি মোড়ের হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু হাসপাতালে আসতে আসতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। করোনার সময় এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এই অবস্থায় এগিয়ে এসেছেন চিকিৎসক হোসেন আহম্মদ। তাঁর উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে 'বন্দর ইপিজেড পতেঙ্গা করোনা হাসপাতাল'। তাঁর এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন স্থানীয় প্রায় ৮০ তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। হাসপাতালের অর্থায়নে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও শুভকাঙ্ক্ষীরা।
হাসপাতাল পরিচালনায় যুক্ত হান্নান সুজন জানান, এখন পর্যন্ত বর্হিবিভাগে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অনুমোদন পেলে রোগী ভর্তি শুরু হবে। তবে রোগী ভর্তির জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের একার পক্ষে শতভাগ সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই ধরনের বেসরকারি উদ্যোগগুলো যদি যথাযথ নিয়ম মেনে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেয় তাহলে মানুষের উপকার হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও তাদের উৎসাহিত করা হবে।