করোনা নিয়ে বাড়ল আতঙ্ক ও হতাশা

>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বললেন, আগামী দুই থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থাকবে।

মানুষ যখন আগামী দু-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখনই গভীর অনিশ্চয়তার কথা শোনালেন দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গতকাল বৃহস্পতিবার অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে হাজির হয়ে মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বললেন, করোনা পরিস্থিতি এক, দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না। আগামী দুই থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থাকবে। তবে সংক্রমণ উচ্চহারে না–ও থাকতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তার এ বক্তব্যে সাধারণ মানুষ হতাশ আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাপরিচালকের উচিত ছিল মানুষকে আশার কথা, স্বপ্নের কথা শোনানো।’ 

ফেসবুকেও মহাপরিচালকের বক্তব্যের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ডিজি হেলথ ভবিষ্যদ্বাণী দিলেন, আরও দু–তিন বছর থাকবে করোনা। কিন্তু সেটাকে নিয়ন্ত্রণের কোনো পথ বললেন না। এমনকি এর থেকে পরিত্রাণের কোনো রাস্তাও তিনি দেখালেন না।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা ছড়ানো অথবা অন্ধকার দেখানোর জন্য তাঁকে নিশ্চয়ই বেতন দেওয়া হয় না।’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘...এখন যখন হতাশাজনক পরিস্থিতি, যখন সবাইকে আশার বাণী শোনানো উচিত, তখন আপনারা বলছেন হতাশার কথা।’

বিশ্বের প্রতিটি দেশ করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। অনেক দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে, অনেকে চেষ্টা করছে। নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, এমন জায়গায় আবার সংক্রমণ ফিরে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, করোনার সঙ্গে বসবাস করতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদদের অনেকে মনে করেন, কার্যকর কোনো টিকা না আসা পর্যন্ত সংক্রমণ বন্ধ হবে না। কিন্তু সেই টিকার আশায় বিশ্বের কোনো দেশ হাত গুটিয়ে বসে নেই। বিশ্বের কোনো দেশ ভাগ্যের ওপর নিজেদের ছেড়ে দেয়নি। 

করোনা পরিস্থিতি জানার জন্য বহু মানুষ প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় টেলিভিশনের সামনে হাজির হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বেশ কিছুদিন যাবৎ সংবাদ বুলেটিন পড়ে শোনান। গত সপ্তাহে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর পড়তে তাঁর আর ভালো লাগছে না। গতকাল তাঁর সঙ্গে হাজির হন মহাপরিচালক। কিন্তু মহাপরিচালকের বক্তব্যে মানুষকে আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে।

গতকাল বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। গত ৮ মার্চে দেশে রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল না। সমন্বয়ের ঘাটতিও প্রবল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে গত সপ্তাহে কমিশন গঠনের কথা আলোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদে। করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার অদক্ষতা নিয়ে যখন সারা দেশে কথা হচ্ছে, তখনই মহাপরিচালক বিশেষজ্ঞদের দোহাই দিয়ে বললেন, করোনা সহজে যাওয়ার নয়।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন মন্তব্য বুঝতে পারছি না। আপনি যদি সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেন, তা হলে করোনা আজীবন থাকবে। এ রকম কথার অর্থ হচ্ছে হাল ছেড়ে দেওয়া।’ 

আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি তিন মাস ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নানা পরামর্শ দিচ্ছে। এই কমিটির একাধিক সদস্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, দু–তিন বছর করোনা থাকবে—এমন কোনো কথা তাঁরা সরকার বা অধিদপ্তরকে বলেনি। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি নামে ১৭ সদস্যের আরেকটি কমিটি আছে, যারা সরকারকে করোনা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে। এই কমিটিরও একাধিক সদস্য বলেছেন, তাঁরা এ রকম কথা কখনো বলেননি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কাছে তাঁর বক্তব্যের ভিত্তি কী, তা গতকাল বিকেলে জানতে চেয়েছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এই ভাইরাস সহজে যাচ্ছে না। উচ্চহারে সংক্রমণ হয়তো হবে না। সংক্রমণ দু–তিন বছর থাকবে। দেশবাসীকে আগেভাগে এ বিষয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার। 

সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, করোনার সংক্রমণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পর দেশবাসীকে জানানো উচিত পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। হাওয়া থেকে কথা বললে হবে না। মানুষ আশার আলো দেখতে চায়।