কাটে না সময় যেন আর কিছুতে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি উচ্চবিদ্যালয় চট্টগ্রামের শিক্ষক আমি। ২০ বছরের মতো শিক্ষকতা জীবন। কি কর্মব্যস্ত জীবন চলছিল, ক্লাস, জাতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত চীনের কথা গণমাধ্যমে শুনে আসছি, কিন্তু অতটা গুরুত্ব দিয়ে নয়। মনে হলো এত দূরের দেশ থেকে কী করে অদৃশ্য ভাইরাস হানা দেবে আমার দেশে। এর আগে ইবোলাসহ আরও অনেক ভাইরাস ছিল, এভাবে মৃত্যুপুরী তৈরি করেনি আমার দেশে। হঠাৎ করে ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ছোট পরিসরে সম্পন্ন করতে বলা হলো, সরকার বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করল। থেমে গেল চিরচেনা ক্লাস, শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা, সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্তগুলো।

অন্য সময় রোজা বা গ্রীষ্মের দীর্ঘ বন্ধকে মনে হতো সময়টা খুবই কম। নানা রকম জমিয়ে রাখা কাজ, বেড়ানো, সবমিলিয়ে কীভাবে যে সময়গুলো পার হয়ে যেত টেরই পেতাম না। করোনাকালীন কাজকর্মহীন জীবনে একটা মাস বন্ধকে এখন এক যুগ মনে হচ্ছে। সময় যেন স্থির হয়ে আছে কোথাও, এমন মনে হয়। করোনার ভয়াবহতা কী, সেটা বোঝা যায় যখন খুব কাছের মানুষ চলে যায় অদৃশ্য শক্তির কাছে হেরে।

এর মধ্যে রোজায় খবর এল, আমার সেজ ফুফু করোনায় আক্রান্ত, এক দিনের মাথায় মারা গেলেন। দুই দিন পর ফুফা মারা গেলেন, কী ভয়ংকর দিন পার করছে আমার ফুফাতো ভাইবোন। আমি চট্টগ্রামে বসে যেন চোখের সামনে তা দেখতে পাচ্ছি। অথচ আমার কিছুই করার নেই, দোয়া করা ছাড়া। ফুফাতো ভাইবোন চিকিৎসা নিয়ে করোনা মুক্ত হয়ে বাসায় ফিরলেন। তাঁরা বলছেন যেন পুলসিরাত পার হয়ে এসেছে। এমন রোগ চারপাশে এত আত্মীয়স্বজন অথচ বিপদে কেউ ভয়ে আসছে না।

কোভিড স্বাস্থ্যবার্তায় আমাদের মানবতার কথা বলে প্রিয়জনের পাশে থাকার, আসলে কি সত্যিই থাকতে পারছি? যদি থাকি, তাহলে রোগের ভয়ে সন্তান কেন মাকে ফেলে চলে যায়, এত মৃত্যু ভয়! কোভিড রোগীর স্বজনেরা কেন সামাজিকভাবে হেয় হয়। মন্দের ছবি যেমন আছে, তেমনি ভালো কাজের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তারাই তো আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। স্যালুট তাদের।

আমরা ভার্চ্যুয়াল জগতে সবাই বুঁদ হয়ে থাকি, মনে হয় কত কাছের আমরা সবাই—আসলেই কি তাই! এই প্রশ্নটা আমাকে ভাবায়, তাই দূরে থাকি এ মাধ্যম থেকে। একসময় এগুলো ছাড়াও দূরের মানুষ অনেক বেশি আত্মার কাছে ছিল। সত্যিকারের ভালোবাসা ও নির্ভরতার একজন মানুষ কাছে থাকলে জীবনে অনেক বন্ধুর পথ আপনি পাড়ি দিতে পারবেন। সে হাতটাই আজ খুঁজে নিতে হবে। লকডাউনে বলিউডের সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা সে কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। আমরা কতটা নিঃসঙ্গ থাকি, বাইরে থেকে কেউ তা বোঝার নেই, দুঃখ শেয়ার করার মতো আমাদের যখন কেউ থাকে না, তখনই বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়। আমার এক সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত, প্রতিদিন আমি তার খোঁজ নিই, এক রুমে বন্দী জীবন কতটা দুর্বিষহ, সে কথাই সে বারবার বলছে, কেউ খোঁজখবর নিলে মনে সাহস বাড়ে। জীবনে অর্থকড়ির চেয়ে বন্ধুত্ব, প্রিয়জনের সাহচর্য অনেক মূল্যবান—সে কথার মর্ম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারেন।

আমার শিক্ষকতার জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হতে হবে ভাবিনি। অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ কখনো কখনো অসহ্য লাগত। এখন মনে হয়, গৃহবন্দি এ জীবন থেকে সে ঢের ভালো। আমার মতো সব শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে উদগ্রীব হয়ে আছি।

জুনে আমার স্কুলে জুমে ক্লাস শুরু হলো, কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছি না, নেই শ্রেণিকক্ষের মতো প্রাণের ছোঁয়া। পিঞ্জরবন্দী পাখির মতো নিজ গৃহকোণে সবাই ছটফট করছি, কখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াব, সেই আশায় বসে আছি। হাত ধুতে হবে বারবার জীবাণুমুক্ত থাকার জন্য। আমাদের মনকেও জীবাণুমুক্ত করতে হবে বারবার ধুয়ে, যাতে আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে মানবতার বার্তা পৌঁছে দিতে পারি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হবেন—এ বিশ্বাস আমাদের সবকিছু মোকাবিলা করতে শক্তি জোগায়। করোনাকালীন আমাদের প্রত্যেকের জীবন যেন একটা উপন্যাস, যা বলে হয়তো শেষ হওয়ার নয়। প্রার্থনা করি, ধুয়ে ধুয়ে সবকিছু দূর হয়ে যাক, শুধু থাক ভালোবাসা, জয় হোক মানবতার।

*শিক্ষক, বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]