মরণ গণনাযন্ত্র

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

৮ মার্চ, ২০২০। অফিসের ট্যুর শেষে সারা রাত বাস জার্নি করে সবে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় পৌঁছালাম। যাক, লম্বা একটা ঘুম দিলেই সব ক্লান্তি দূর। বাসায় ফিরে ভাত খেতে খেতেই টিভিতে চোখে পড়ল খবরটা, বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে! মুহূর্তেই এক অজানা ভয় মনে উঁকি দিল। এ দেশে শেষ পর্যন্ত করোনা এসেই পড়ল!

প্রথম আলোর কল্যাণে জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইটের সঙ্গে পরিচয়, যেখানে কিনা প্রতিমুহূর্তের করোনা রোগীর তথ্য আপডেট করা হয়। মাঝেমধ্যেই সেখানে চোখ রাখতাম। ৮ মার্চের পর তো প্রতিদিনই একটু পরপর ঢুঁ–মারাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দিনের শুরুতে অনেক আশা নিয়ে ওয়েবসাইটে ঢুকি যে আজ হয়তো করোনা রোগীর সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে কমবে। যেদিন দেখি রোগীর সংখ্যা কমেছে, সেদিন বেশ আশাবাদী হয়ে যাই আর যেদিন দেখি বেড়েছে, সেদিন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠি। করোনায় মৃতের সংখ্যার দিকেও চোখ আটকে যায়। এ যেন এক মরণ গণনাযন্ত্র! পৃথিবীর কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা সংখ্যায় তাকিয়ে বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়।

মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, প্রতিরোধক বিশেষ চশমা কোথায় কোথায় পাওয়া যায় দেখতে থাকি, অনলাইনে অর্ডার করি। বিভিন্ন সাইট থেকে করোনা–সম্পর্কিত তথ্য-পরামর্শ সেভ করে রাখি। বুয়াকে বাসায় আগামী কয়েক দিন আসতে মানা করে দিই। এটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে আমার সেকি ঝগড়া! বাসায় কেউ এলে ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে করি তাদের গায়ে। দরজার হাতলে স্যানিটাইজার দিয়ে মুছতে থাকি। বাসার সবাই আমার পাগলামীতে বিরক্ত।

তবে এই করোনার কিছু অদ্ভুত দিকও রয়েছে। করোনাকাল স্ত্রীকে বানিয়েছে নাপিত, স্বামীকে বানিয়েছে রাঁধুনি! পত্রিকায় বিরাট কোহলি-আনুশকার চুল কাটার ছবি দেখে বউকে জিজ্ঞাস করলাম, আনুশকার মতো করে চুল কেটে দিতে পারবে কি না। নাপিতবিহীন এই সময়ে আর কী উপায়! কাঁচি, চিরুনি, ট্রিমার নিয়ে ৪৫ মিনিট যুদ্ধের পর বাকিটা ইতিহাস! মাথায় খোপ খোপ চুল পৃথিবীর মানচিত্রের রূপ নিয়েছে!

ঈদের ঠিক আগে আগে হঠাৎ স্বাদ-গন্ধহীনতা অনুভব করলাম। কোনো খাবারে স্বাদ নেই, গন্ধও নাক থেকে উধাও। ইন্টারনেট, পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, করোনার অন্যতম প্রধান লক্ষণ স্বাদ-গন্ধহীনতা। মনে মনে নিজেকে সাহস দিলাম। করোনা টেস্ট করাতে এবং অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে কোথায় কোথায় যোগাযোগ করতে হবে ঠিক করে রাখলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে অন্যান্য সমস্যা না দেখা দেওয়ায় সেসবের প্রয়োজন পড়েনি। ধীরে ধীরে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি ফিরে পেতে লাগলাম।

এদিকে সেই মার্চ থেকে এই পর্যন্ত আমাদের হোম অফিস চলছে। জুনে যখন সীমিত আকারে অন্যান্য অফিস খুলছে, তখনো আমাদের অফিস খোলার ঘোষণা দেয়নি। আইটি সেক্টরে অনেক কাজই ঘরে বসে করা সম্ভব। তারপরেও করোনার প্রভাব তো কমবেশি সব ক্ষেত্রেই পড়েছে। আমার স্ত্রীর আবার সরকারি চাকরি করে, তার তো অফিসে যেতেই হয়। যতই মাস্ক-গ্লাভস পরে অফিসে যাক, ঝুঁকি তো থাকেই। অফিস খোলার কদিন পরেই শুনি তার পাশের এক কলিগের করোনা পজিটিভ! ওদের ডিপার্টমেন্টের বাকিদের কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত কয়েক দিনে বেশ পরিচিতদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাচ্ছি। বন্ধু, সহকর্মীদের গ্রুপ চ্যাটে এখন শুধু করোনা টেস্ট, রোগী, হাসপাতাল–সংক্রান্ত কথাবার্তায় ভর্তি। অমুকের ভাই করোনা পজিটিভ তো তমুকের বাবা হাসপাতালে ভর্তি। পরিচিত অনেক ডাক্তারও আক্রান্ত। অনেকে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার এখন সোনার হরিণ। অথচ সৃষ্টিকর্তা বিনা মূল্যে প্রকৃতিতে অফুরন্ত অক্সিজেন দিয়ে কত সহজেই না আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার ব্যবস্থা করেছেন।

খানিক বাদেই আবার অভ্যাসবশত আবার চোখ রাখি সেই করোনায় আক্রান্ত-মৃতের হিসাবে। কবে থামবে এই মরণ গণনাযন্ত্র! কবে মুক্তি পাবে মানবজাতি!


*সিনিয়র প্রোগ্রামার, মাইক্রোম্যাক টেকনোভ্যালি লিমিটেড, ঢাকা। [email protected]