এ এক বড্ড অস্বাভাবিক সময়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

নিশুতি রাত। আধফালি চাঁদ আকাশে। রাতজাগা পাখিটা অবিরাম ডাকছে। আমি জানালার গ্রিল ধরে অসীম আকাশের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। ওই অন্তহীন আকাশে নক্ষত্রবিথীরা মিটিমিটি করে জ্বলছে। অনন্তকাল ধরে চলছে আলো-আঁধারের ক্লান্তহীন লুকোচুরি। এই লুকোচুরি দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুই মাসের অধিক সময়। এ এক বড্ড অস্বাভাবিক সময়।

এখন অস্বাভাবিকতার সঙ্গে বসবাস শুরু হয়েছে আমাদের। বিস্ময়করভাবে নিজেকে খুব অচেনা লাগে। এই তো তিন মাস আগের কথা। যখন প্রথম একজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে, তখন ভয়ে আতঙ্কে মুষড়ে গিয়েছিলাম। চলাচল সীমিত রেখেছিলাম। লকডাউনের প্রথম প্রহরে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এমনকি রুমের দরজা-জানালা পর্যন্ত বন্ধ রাখতাম।

পরিবর্তনের দমকা হওয়ায় বদলে গেছে চারপাশ। আর পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা মানুষের সহজাত প্রবণতা। আমি এর ব্যতিক্রম নই। গত দুই মাসে পৃথিবী যতটা বদলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বদলে গেছি আমি। পরিস্থিতি ও সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছি।

আগে যা কখনো করতাম না, এখন জীবনের প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় সেগুলো করি। বাসার সব কাজ নিজের হাতে করি। কাপড়চোপড় থেকে বাথরুম পর্যন্ত পরিষ্কার করতে হয় আমাকে।

নিজের মধ্যেই আবিষ্কার করি জীবন ও জীবিকার এক অসম লড়াই। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন অর্থ, আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে জীবিকার পক্ষে যুক্তি অনেক বেশি। বসে থাকলে চলবে না। তাই তো সবার মতো আমাকেও জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে।

সময়ের প্রয়োজনে বদলে ফেলতে হয়েছে আমার চিরচেনা রুটিন। অনলাইনে অর্ডার করে একটা বাইসাইকেল কিনেছি, সঙ্গে হেলমেট। এটাই আমার চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। পোশাকেও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। ফরমালের জায়গায় স্থান নিয়েছে জিন্স, কেডস ও টি-শার্ট।

এবার খাবারের ব্যবস্থা। যে অলস আমি ঘুম থেকে জেগে ঝিমাত ঝিমাতে অফিসের গাড়িতে উঠতাম। সময়ের আবর্তে সেই আমি কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জাগি। ব্রেকফাস্ট তৈরি করি, লাঞ্চ তৈরি করি। এখন বেশ ভালো রাঁধুনি আমি! সুন্দর করে থরে থরে টিফিন বাটিতে খাবার সাজিয়ে নিই। ফ্লাক্স ভর্তি করে নিই গরম পানি। কয়েক টুকরো আদা, গ্রিন টির প্যাকেট, লেবু, লবঙ্গ একটি বাক্সে ভরে নিই। সঙ্গে চা খাওয়ার মগ এবং এক বোতল পানি।

গোসল সেরে সবকিছু সাবধানে ব্যাকপ্যাকে ভর্তি করি। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক এবং মাথায় হেলমেট পরে ব্যাকপ্যাক নিয়ে দ্বিচক্রযানে রওনা দিই অফিসের উদ্দেশে। এভাবেই চলছে অফিসে আসা-যাওয়া এবং খাওয়া।

বদলে গেছে অফিসের পরিবেশ। ডেস্কের পানি রাখার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। একসঙ্গে কলিগদের সঙ্গে চা খাওয়া হয় না। কারোর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা হয় না। জন্মদিনের সেলিব্রেশন আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কাউকে আর ট্রিট দিতে বলে না।

আমগাছের শাখা-প্রশাখায় এখন কাঁচা-পাকা আম মৃদু বাতাসে দুলছে। কদিন আগেও সেগুলো মুকুলে ভরপুর ছিল। মানুষের কলতানে মুখরিত চিরচেনা ফুটপাত। গাড়ির হর্নের বিকট শব্দ শুনছি অবিরত। ওপরের ফ্ল্যাটে দুজন আক্রান্ত। তবু জানালা খোলা থাকে দক্ষিণা হওয়ার জন্য। নাহ, আর ভয় করে না। হাজার হাজার আক্রান্ত এবং সহস্রাধিক মৃত্যুও তেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। আমার নামও এ সংখ্যায় যুক্ত হতে পারে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে এভাবেই ছুটতে হয়। অস্বাভাবিকতাকে সহ্য করে নিতে হয়। সে জন্য হয়তো চরম অস্বাভাবিক এ সময়কে বড় বেশি স্বাভাবিক মনে হয়।

* ডেপুটি ম্যানেজার, ইন্টারন্যাশনাল রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন, রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, মিরপুর, ঢাকা। [email protected]