রাজশাহী মহানগর: সংক্রমণ বাড়ছে, কমছে সচেতনতা

সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে ভিড় করেছেন মানুষেরা। আজ শনিবার রাজশাহীর কুমারপাড়া এলাকায়। ছবি: শহীদুল ইসলাম
সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে ভিড় করেছেন মানুষেরা। আজ শনিবার রাজশাহীর কুমারপাড়া এলাকায়। ছবি: শহীদুল ইসলাম

শনিবার বেলা ১১টা। রাজশাহী নগরের কুমারপাড়ায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে আম বুকিং করছিলেন পবা উপজেলার ইকবাল হোসেন। তাঁর সঙ্গে আসা পাঁচ-সাতজন শ্রমিক ভ্যান থেকে আম নামাচ্ছিলেন। তাঁদের মতো আরও কয়েকটি দল এসেছে আম বুকিং করতে। অধিকাংশের মাথায় বাঁধা গামছা, মুখে মাস্ক নেই। কুরিয়ারের কার্যালয়ের ভেতরে তিল পরিমাণ জায়গা নেই। সেখানে কেউ কাউকে সচেতনও করছেন না। পাশেই একটি খাবার হোটেল ও চায়ের স্টল। সেখানেও ভিড় লেগে আছে।

ঘণ্টাখানেকের মাথায় নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে পড়া পদ্মার পাড়ে গিয়ে দেখা গেল, নদীপাড়ের শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়াতে অনেকেই ভিড় জমিয়েছেন। সেখানেও চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আড্ডা চলছে। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিয়ে কারও কোনো খেয়াল নেই। সেখানে দাঁড়ানোর ১৫ মিনিটের মাথায় শোনা গেল মাইকের আওয়াজ—‘আপনারা মাস্ক পরুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান।’ হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী মোস্তফা কামালের জানানো এই আহ্বান সবার কানেই পৌঁছাল, কিন্তু মানলেল না প্রায় কেউই। দু-একজন টিপ্পনীও কাটলেন।

এ ধরনের মাইকিং মার্চের মাসের শেষ দিক থেকে রাজশাহী মহানগরে শুরু হয়েছিল। রাজশাহী সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই কাজটি করে আসছিল। কিন্তু সংক্রমণ বাড়তে থাকার এই সময়ে সেই কার্যক্রমে যেন ভাটা পড়েছে। আর এরই মধ্যে রাজশাহী মহানগরে করোনাভাইরাসের সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ১৫ মে পর্যন্ত নগরটি ছিল করোনামুক্ত।

নগরবাসী বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে রাজশাহীতে সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসন যেমন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তেমনি মানুষজনও সচেতনভাবে সবকিছু মেনে চলেছেন। তার সফলতাও মিলেছিল। দেশে কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার ৬৭ দিন পর প্রথম রাজশাহী মহানগরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। কিন্তু এখন করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা কমছে।

শুরুটা ছিল সফল
রাজশাহীতে সংক্রমণ এড়াতে গত ২০ মার্চ থেকে সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় পরিবহন সংগঠনগুলো। এরপর এপ্রিলের শুরু থেকেই পুরোদমে মাঠে প্রশাসন নেমে পড়ে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনসহ জনপ্রতিনিধিরা মাঠে নেমে লিফলেট, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ করা শুরু করে দেয়। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই জীবাণুনাশক দিয়ে প্রধান প্রধান সড়ক ধুয়ে দেওয়া হতো। নগরের অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি স্থানে বুথ বসিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও লিফলেট বিলি করা হতো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে, মার্কেটের সামনে করা হয়েছিল হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। সবার সমন্বয়ে করোনার প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল সবাই।

গত ১২ এপ্রিল জেলার পুঠিয়ায় প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল সকাল থেকে জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করে জেলা প্রশাসক। তখন নগরে আরও কড়াকড়ি জারি করা হয়। নগরের অটোরিকশা থেকে শুরু করে দোকানপাট, ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে নগরের মানুষজনকে সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হয়। এ অবস্থা চলতে থাকে গত ৯ মে পর্যন্ত।

করোনা নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবক। শনিবার রাজশাহী নগরের বড়কুঠি পদ্মাপাড়ে। ছবি: প্রথম আলো
করোনা নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবক। শনিবার রাজশাহী নগরের বড়কুঠি পদ্মাপাড়ে। ছবি: প্রথম আলো

গত ১০ মে থেকে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলার অনুমতি দিলে সবাই দোকান খোলে। সেদিন থেকেই শহরে মানুষ বাড়তে থাকে। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদেরও তৎপরতা কমতে থাকে। এর মধ্যেই এসে যায় ঈদ। ঈদে রাজশাহী নগরে প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে। ঈদের পর থেকেই নগরের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। আর মানুষের মধ্যে সচেতনতাও কমতে থাকে।

নগরে সংক্রমণের ৩৫তম দিন
দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। রাজশাহী জেলায় প্রথম এই রোগী শনাক্ত হয় ১২ এপ্রিল। আর রাজশাহী মহানগরে এই রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ১৫ মে। অর্থাৎ দেশে এই রোগী শনাক্ত হওয়ার ৬৭ দিন পর প্রথম কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন রাজশাহী মহানগরে। ৬৮তম দিনে কোভিড শনাক্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন চলছে ৩৫তম দিন। গত ২৫ মে ঈদের আগ পর্যন্ত রাজশাহী নগরের সংক্রমিত হয়েছিলেন মাত্র ৭ জন। যাঁরা সবাই ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। ৩১ মে পর্যন্ত ১৬ দিনে আক্রান্ত হন ৯ জন। এরপর ১৬ জুন এক দিনে নগরের ৯ জন রোগী শনাক্ত হয়ে মোট ৫৮ জন হয়। নগরে প্রথম ৫০ জন রোগীর সংখ্যা হতে সময় লাগে ৩২ দিন। এ থেকে ১০০ রোগী পার হয় মাত্র ৩ দিনে—৩৫তম দিনে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। সুস্থ হয়েছেন ৮ জন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডে প্রায় ১১ লাখ মানুষের বসবাস। গত ১৫ মে নগরের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। গত শুক্রবার পর্যন্ত (১৯ জুন) ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধু তিনটি (১১, ১৬ ও ২৯) ওয়ার্ডে করোনা শনাক্ত হয়নি। বাকি সব ওয়ার্ডেই শনাক্ত হয়েছে করোনার সংক্রমণ। এর মধ্যে নগরের রাজপাড়া থানাধীন ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ৯ জন আছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন ৭ জন। এ ছাড়া ৭, ৮, ১৩, ১৪ ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ জন করে শনাক্ত হয়েছেন।

‘ইয়েলো জোনে’ রাজশাহী
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন মোহা. এনামুল হক জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এলাকাভিত্তিক জোনিংয়ের যে নির্দেশনা দিয়েছে, তাতে জনসংখ্যার অনুপাতে এখন ইয়েলো জোনে রয়েছে রাজশাহী মহানগর। তিনি বলেন, প্রতিদিনই মহানগরে সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা বেশি করলে হয়তো এক দিনেই আরও বহুসংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হবেন। তাঁরা এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের দিকে লক্ষ রাখছেন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, মহানগরে রোগী ৯৩ জন। বাকি আটজন মহানগরঘেঁষা পবা উপজেলার। তাঁদের চিকিৎসাকর্মীরা রোগীদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। তবে তাঁরা এত বেশি রোগীর খোঁজখবর নিতে পারছেন না। এ জন্য যেকোনো প্রয়োজনে রাজশাহী মেডিকেলেও ফোন দিতে রোগীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

‘মডেল হতে পারত রাজশাহী নগর’
রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ সবাই মাঠে ছিল বলেই মহানগরে পরিস্থিতি ভালো ছিল। করোনামুক্ত ছিল দুই মাসের বেশি সময়। রাজশাহী মহানগর করোনা প্রতিরোধে একটা মডেল হতে পারত। কিন্তু সরকার গণপরিবহন চালু করে দিয়ে অবাধে মানুষের যাতায়াত করার সুযোগ করে দিল। এতে ব্যাপক মানুষ এসে রাজশাহীকে সংক্রমিত করেছে। সরকার নতুন করে জোনভিত্তিক যে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা মনে হয় না কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ। পুরোপুরি লকডাউন ছাড়া এ অবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে না।

সংক্রমণের শুরুর দিকে করোনার সুরক্ষায় বসানো হয়েছিল হাত ধোয়ার বেসিন। এখন সেগুলোতে সাবান, পানি কিছুই নেই। শনিবার রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায়। ছবি: শহীদুল ইসলাম
সংক্রমণের শুরুর দিকে করোনার সুরক্ষায় বসানো হয়েছিল হাত ধোয়ার বেসিন। এখন সেগুলোতে সাবান, পানি কিছুই নেই। শনিবার রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায়। ছবি: শহীদুল ইসলাম

শুরুর মতো সচেতনতা কার্যক্রম বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে কি না জানতে চাইলে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘এটা হ্রাস পেয়েছে ঠিক সেভাবে বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে। তবে আমরা চিকিৎসাসেবা, ল্যাব, পরীক্ষার সুবিধা বাড়িয়েছি। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজকেও নামতে হবে। সর্বোপরি মানুষকে সচেতন হতে হবে।’

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বলেন, তাঁরা প্রতিদিন রাজশাহী জেলাসহ মহানগরের করোনা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। কোন এলাকায় কত রোগী বাড়ছে, সেটা দেখা হচ্ছে। তাঁরা সরকারের পরিকল্পিত জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে প্রস্তুত রয়েছেন। এ জন্য সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে তাঁদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। সচেতনতা কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি না মানার জন্য জরিমানাও করছেন। যাঁদের টাকা নেই, একটু কম আয়ের, তাঁদের মাস্ক দিচ্ছেন। এ ছাড়া কমিউনিটি পর্যায়ে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অনলাইনে কথা বলা চেষ্টা করছেন। যাতে কমিউনিটি পর্যায়ের মানুষগুলোকে কিছুটা হলেও সচেতন করা যায়।