মা হারানো দুধরাজের ছানাগুলো বড় হচ্ছে বাবার যত্নে

সড়কের পাশের বাঁশঝাড়ে বাসা বেঁধেছিল এক দুধরাজ দম্পতি। কিছুদিন পরে ঘরে আসে নতুন অতিথি। শান্ত সুখের নীড়ে ফুটফুটে তিনটি ছানা নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। একজন ছানাদের পাহাড়া দেয়, অন্যজন জোগাড় করে আনে খাবার। হঠাৎ একদিন মা পাখি, ছানাসহ বাসাটি তুলে নিয়ে যান এক যুবক। পাখিপ্রেমী কিছু মানুষের সহায়তায় বাসাটি উদ্ধার হলেও আর খোঁজ মেলেনি মা পাখির। এরপর থেকে বাবার যত্নেই বড় হচ্ছে ছানা তিনটি।

পাখি দম্পতির এই গল্প পাবনার শহরের অদূরের মালঞ্চি এলাকায়। লম্বা লেজবিশিষ্ট সুদর্শন দুধরাজ পাখির ইংরেজি নাম Asian Paradise Flycatcher। যার বৈজ্ঞানিক নাম terpsiphone paradisi।এরা শাহি বুলবুলি, সাদা সিপাহি বা লাল সিপাহি নামেও পরিচিত। পাখিবিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রীর মূল পার্থক্য বোঝা যায় লম্বা লেজ দেখে। স্ত্রী পাখির লেজ ছোট ও তাতে লম্বা ফিতার মতো পালক নেই, যা পুরুষের আছে। পুরুষ ছানারা দু-তিন বছর পর্যন্ত লালচে বা লালচে-বাদামি থাকে, তারপর প্রাপ্তবয়স্ক হলে একেবারে দুধসাদা রঙের হয়ে যায়। এই জন্যই হয়তো এর বাংলা নাম দুধরাজ।

পাবনা সদর উপজেলার মালঞ্চি এলাকার তরুণ আশিক রহমান। তাঁর বাড়ির পাশেই বাসা বেঁধেছিল দুধরাজ পাখি দুটি। আশিক জানান, মে থেকে জুলাই মাস প্রজনন মৌসুম হওয়ায় পাখি দুটি রাস্তার পাশের বাঁশঝাড়ে বাসা বেঁধেছিল। এরপর স্ত্রী পাখিটি ওই বাসায় তিনটি ডিম দেয়। সারা দিন বাসায় বসে ডিমে তা দিত সে। আর আশপাশে পাহারা দিত পুরুষ পাখিটি। সম্প্রতি তাদের ডিম ফুটে বেরিয়েছিল তিনটি ছানা। এরপরই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় বাবা ও মা পাখিদের। খিদে পেলেই ডাকাডাকি শুরু করে ছানারা। আর পালাক্রমে খাবার জোগাড় করে আনে বাবা-মা। তবে খাবার সরবরাহের চেয়ে বাসার নিরাপত্তার দিকেই বেশি নজর থাকে বাবা পাখিটির। অন্য শিকারি পাখি বা প্রাণী বাসার কাছে এলেই কর্কশ স্বরে তাকে তাড়িয়ে দেয়।

আশিক রহমান জানান, অনেক দিন ধরেই দুর্লভ পাখির বাসাটিকে লক্ষ করছিলেন তিনি। বাড়ির পাশে হওয়ায় প্রতিদিন চার বেলা দেখতে যেতেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সকালে সেখানে বাসাটি না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। দুপুরে জানতে পারেন এক যুবক মা, ছানা পাখিসহ বাসাটি নিয়ে গেছেন। পাখিদের পোষ মানাবে, এমনই চিন্তা ছিল তার। পরে স্থানীয় একটি সংগঠনের সহযোগিতায় ছানাসহ বাসাটি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মা পাখিটির কোনো খোঁজ আর মেলেনি। মেরামত করে আগের সেই স্থানে বাসাটি রাখার হয়। ছানাদের ডাকাডাকিতে কিছুক্ষণ বাদেই খাবার নিয়ে বাসায় উড়ে আসে বাবা পাখিটি। আশিক বলেন, ‘এই দৃশ্য কোনো দিন ভোলার মতো না। মা–হারা ছানাদের পরম ভালোবাসায় আবার গ্রহণ করে পুরুষ পাখিটি। বাসার নিরাপত্তার পাশাপাশি খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে যায় একাকী বাবা দুধরাজ পাখিটি।’

খাবার সংগ্রহ করে এনে ছানাদের মুখে তুলে দিচ্ছে পুরুষ দুধরাজ পাখিটি। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) বিকেলে পাবনা সদরের মালঞ্চি এলাকায়। ছবি: হাসান মাহমুদ
খাবার সংগ্রহ করে এনে ছানাদের মুখে তুলে দিচ্ছে পুরুষ দুধরাজ পাখিটি। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) বিকেলে পাবনা সদরের মালঞ্চি এলাকায়। ছবি: হাসান মাহমুদ

পাবনার প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীবিষয়ক সংগঠন নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন কমিউনিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আশিকের মাধ্যমে যুবকটির কাছ থেকে ছানাদের উদ্ধার করে আগের স্থানে রাখার পর বাবা পাখিটি তা আবার গ্রহণ করেছে এবং ছানাদের খাবার খাওয়াচ্ছে। প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আশিকের মতো এভাবেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’