'আমার বাবা আপনাদের ঠকাবেন না'

বাবা পুনুরদান গাইন ও মেয়ে রিপা গাইন। ছবি: সংগৃহীত
বাবা পুনুরদান গাইন ও মেয়ে রিপা গাইন। ছবি: সংগৃহীত

পুনুরদান গাইন গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাঠের কাজ করেন। তবে কয়েক বছর ধরেই ব্যবসাটা ঠিক চলছে না। করোনাভাইরাসের বিস্তারে কাজ প্রায় থমকেই গিয়েছিল। পুনুরদান গাইনের একমাত্র মেয়ে রিপা গাইন বাবার মনমরা হয়ে থাকার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। মেয়ে বাবার ব্যবসাকে চাঙা করতে বাবাকে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে দেন চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে। তারপর পেজটিতে নতুন কাজের অর্ডার এসেছে চারটি। আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই বাবা ও মেয়েকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন অনবরত।

৫৫ বছর বয়সী পুনুরদান গাইন লেখাপড়া করেননি। রাজধানীতে মিরপুরের বাসায় কাঠের কাজ করে বা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া কাজ করেই তিনি সংসার চালান। তবে একমাত্র মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন। মেয়ে এখন চাকরি করছেন। টেলিফোনে হাসতে হাসতে বললেন, ‘মেয়েটার আমার জন্য অনেক টান। ও আমারে নিয়া অনেক ভাবে। এইভাবে যে ব্যবসা করা যায়, তা তো আমার মাথাতেই আসে নাই। এখন হালকা-পাতলা কাজের অর্ডার আসতেছে। আমার মেয়েটার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’

পুনুরদান গাইন জানান, দুজন কর্মচারী রেখেছেন কাজের জন্য। আর তিনি নিজে নকশা থেকে শুরু করে সব কাজে হাত লাগান। যেকোনো নকশার আসবাব বানাতে পারেন।

মেয়ে রিপা গাইন বললেন, ‘বাবার জন্য পেজটা খুলেছি খুব বেশি দিন হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই ভালো সাড়া পেয়েছি। বাবা চারটা কাজের অর্ডার পেয়েছেন। পেজে অনেকেই বিভিন্ন আসবাবের ছবি দিয়ে জানতে চাচ্ছেন, বাবা তা বানিয়ে দিতে পারবেন কি না। অনেকে বলে রাখছেন করোনা শেষ হলেই বাবার কাছ থেকে আসবাব বানাবেন। অনেকে আমাদের বাবা আর মেয়ের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছেন। বাবা এখন খুব খুশি। ফেসবুকের মাধ্যমে এভাবে ব্যবসা করা যায়, তিনি ঠিকমতো তা বুঝতেও পারছেন না। এখন অর্ডার না পেলে শুধু জানতে চান, কিরে, আর কেউ তো কিছু অর্ডার দিচ্ছেন না।’

রিপা বললেন, যাঁরা আসবাব বানাতে চান, তাঁরা পেজে কোন জিনিসটার মতো বানাতে চাচ্ছেন, তার ছবি দেন। বাবা সবকিছু দেখে কোন কাঠ, কতটুকু লাগবে, মজুরি কত দিতে হবে, সব বলে দেন। পছন্দ হলে অর্ডার চূড়ান্ত করেন।

রিপা বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বাবা কাঠের কাজ করেন। এ কাজ করেই বাবা আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। বাবার চাপ কিছুটা কমানোর জন্য আমি টিউশনি করতাম। বাবা কাঠের মিস্ত্রি বা কাঠের কাজ করেন, এ নিয়ে আমার মধ্যে কখনোই কোনো হীনম্মন্যতা কাজ করেনি। এমনকি ইন্টারভিউ বোর্ডসহ কোনো জায়গাতেই বিষয়টি গোপন করিনি। কেউ যখন জানতে চান বাবা কী করেন, আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই বলি আমার বাবা কাঠের কাজ করেন।’

রিপা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার বগুড়া অফিসে আইটি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমানে বাসা থেকেই অফিস করছেন। তিনি জানান, তাঁর বাবার জন্য খোলা পেজটি বর্তমানে পরিচালনা করছেন, বাবা সব শিখে গেলে তখন তিনিই তা পরিচালনা করবেন। আর বাবার ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন পেজে, কেউ আসবাব বানাতে চাইলে সরাসরি ফোন নম্বরে যোগাযোগ করছেন।

রিপা বললেন, ‘মা এলিজাবেথ গাইন বা বাবা তাঁদের ছেলেসন্তান নেই বলে কখনোই আফসোস করেন না। আমাকে তাঁরা তাঁদের সবটুকু দিয়ে মানুষ করেছেন। বাবার মুখে একটু হলেও হাসি আনতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।’

রিপা অনলাইনে নারীদের ই-কমার্স গ্রুপ ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) পেজে ‘ইনি আমার বাবা’ লিখে যে পোস্ট দিয়েছেন তাতে লিখেছেন, ‘হঠাৎ করে চিন্তা করলাম বাবার জন্য একটা পেজ খুলব, যেন সে তাঁর কাজ করে মনকে ভালো রাখতে পারেন। P & R Furniture by Punurdan Gayen বাবার নামটা অ্যাড করে দিয়েছি, তাঁকে সবাই জানুক, চিনুক। সবাই একটু রেসপন্স করলে আস্থা পাব।’

আজ রোববার বাবা দিবস। আর বাবা দিবসেই ফেসবুকে রিপা পোস্টে লিখেছেন, ‘বাবা দিবসে বাবা নতুন অর্ডার পেল, কী যে খুশি লাগছে। কদিন ধরেই বাবা কানের কাছে বলছিল, কিরে, কেউ অর্ডার দিচ্ছে না। এখন কাজটি পেয়ে বাবা খুবই খুশি।’

রিপা তাঁর বাবার কাজ নিয়ে ফেসবুকে সবার জন্য লিখে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার পেজে আসবাবের যেসব ছবি দেওয়া, তা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। এসব নকশার সঙ্গে মিল রেখে তাঁর বাবা সেগুন, গর্জন, মেহগনি, কেরোসিন কাঠ অথবা গর্জন বা সেগুন প্লাই-উড দিয়ে বানিয়ে দেবেন। যেন আপনারা তা সুন্দর করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করতে পারেন। রিপা লিখেছেন, ‘আমার বাবা আপনাদের ঠকাবেন না। আমার বাবা ভালো মানের কাঠ বা প্লাই দিয়ে জিনিস বানিয়ে দেবে, তাই আপনার দামে পুষলে আপনি অর্ডার করবেন। আমার বাবা বাজে কাজ করে টাকা ইনকাম করবেন না আর গালিও খাবেন না।’