আবার কবে সকাল ছয়টায় অ্যালার্ম বাজবে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মাস্টার্সে এসে স্যার বানিয়ে দিলেন সিআর (CR)। সবাই ক্লাসের জন্য নিয়মিত নক আমাকেই দিতেন। কখন কোন ক্লাস? এই স্যার আছেন কি না? ওই স্যার ক্লাস নেবেন কি না? সামনের সপ্তাহের ক্লাস টেস্ট দেব না, স্যারকে বলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখন কেউ নকই দেয় না, এমন কোনো তথ্যের জন্য।

এখনো প্রায় নিয়মিত ঘুম ভেঙে যায় খুব সকালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দিনগুলোর মতোই শুরু হয় সকাল। তবে মাঠে প্রাকটিসে যাওয়ার জন্য আর রেডি হতে হয় না। সকালে ঘুম ঘুম চোখে উঠেই মোজা, কেডস পরে শীতের সকালে ট্রাকসুট পরে প্রথমে রানিং করা টিমের সবাইকে নিয়ে। সামনে বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০ সামনে রেখে নিবিড় প্রশিক্ষণ নিয়মিত সকাল ও বিকেলে দুবেলা সেই তীব্র গরমে তিন মাসে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আবার কবে জমে উঠবে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া অঙ্গনের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই? আবার কবে সকাল ছয়টায় অ্যালার্ম বাজবে মাঠে প্রাকটিসের জন্য?

এই তো তিন মাস আগেও হলে ছিলাম—রুমমেটরা মিলে রাতে হলের ছাদে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা, কারও জন্মদিন হলেই মুড়ি মাখানো, কখনো কখনো যার জন্মদিন তার মাথায় ডিম ভাঙা। রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে তুমুল ফুটবল খেলা।

বুঝতেই পারলাম না কোথা থেকে কী হয়ে গেল। তিনটা মাস বাসায়। করোনা নামক মহামারি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সবাই গৃহবন্দী। চীনে শুনেছি গত বছরের শেষের দিকে করোনা নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা। তারপরে একটা নিউজ ওই সময়টাতে শুনলাম ৮ মার্চ বাংলাদেশে নতুন করে দুজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিল, ১৯ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যেই হল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কী করব? কোথায় যাব? কারও মেসে থেকে টিউশনি করাব কি না? ভার্সিটি একদম হঠাৎ করে বন্ধ হলো, কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু লকডাউন।

যে যার মতো হল থেকে দেশের বাড়িতে চলে গেছে আম্মা–আব্বার কাছে। কিছু ছাত্র হয়তো লকডাউন বুঝতে না পেরে মেসে থেকে গেল। কেউ কেউ সেখানেই রয়ে গেছে এখনো বাসায় যায়নি।

এ তিন মাসে জীবনের অনেক রং বুঝতে পেরেছি, নতুন করে সমাজকে দেখেছি, সমাজে যেসব জনপ্রতিনিধি আমাদের চারিত্রিক সনদ দেন, তাঁদের চাল চুরির সংবাদ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে খুব হতাশ হয়ে পড়ি, এই বছরটা গেলেই তো মাস্টার্স শেষ করতে পারতাম, কিন্তু এখন কবে শেষ হবে মাস্টার্স?

উল্টাপাল্টা, ভাবি আবার মনকে ডাইভার্ট করি বিভিন্নভাবে। করোনাকালীন এই সময়টাতে অনেকেই হয়তো নানাভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বা বিভিন্ন মানসিক বা শারীরিক চাপে থাকছে। আমি মনে করি, এই সময়টাতে পরিবারের সবাই সবার প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। আগের মতো বাইরে গিয়ে হয়তো বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে পারছি না। চেষ্টা করি যতটুকু ভালো থাকা যায়, যতটুকু শেখা যায়।

অপেক্ষা করছি সব ঠিক হয়ে যাওয়ার—প্রিয় মুখগুলোকে দেখার। সবাই মিলে সবার প্রিয় ভৌমিক স্যারের ক্লাস করা হবে কি না, জানি না, একসঙ্গে বসে আবার হক মামার টংদোকানে চা খাওয়া হবে কি না, জানি না, ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান স্যারের সেই দরাজ কণ্ঠে বলবেন, ‘ওহে, শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না, মাঠে এসে দৌড়াতেও হবে’, সেটি শোনার সৌভাগ্য হবে কি না জানি না। তবে শুধু অপেক্ষা করছি, সুস্থ সেই পৃথিবীর জন্য।

* শিক্ষার্থী, মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]