ত্রাণ-দুর্নীতিতে বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের অনেকে এখনো তৎপর

রফিকুল ইসলাম, ডাকনাম মলাই, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কোভিড-দুর্গতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নগদ টাকা বণ্টন কর্মসূচির তালিকায় তিনি নিজের ভাতিজাসহ চার স্বজনের মুঠোফোন-ব্যাংক নম্বরে ৩০৬ জনের নাম ঢুকিয়েছেন। উপকারভোগীদের এ তালিকায় মোট ৫৪৯টি নাম তাঁর একক অবদান।

জেলা প্রশাসনের তদন্তে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তালিকায় এককভাবে নামগুলো তুলতে চেয়ারম্যানকে সহযোগিতা করেছেন ইউনিয়ন পরিষদটির (ইউপি) সচিব মোকতার মিয়া।

রফিকুল একা নন। করোনাকালে দরিদ্রজনের জন্য সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে দেশজুড়ে এযাবৎ অন্তত ১০০ জন জনপ্রতিনিধি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু তা পাশ কাটিয়ে তাঁদের অনেকে এখনো ত্রাণের কাজে সক্রিয়।

জেলা পর্যায়ের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বিভাগটির একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, অন্তত ৯০ জনই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত।

সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিশ্চিত বহিষ্কার করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তা হিসেবে সারা দেশে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের একজন করে সদস্যের মুঠোফোন-ব্যাংক নম্বরে ২ হাজার ৫০০ টাকা যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দিচ্ছে চাল, টাকা আর শিশুখাদ্য। মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ওএমএস কর্মসূচিতে ১০ টাকা দরে চাল বিক্রি করছে, যেটা অনিয়মের কারণে মধ্যে একবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই অভিযোগগুলো উঠতে থাকে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জনপ্রতিনিধিদের বলেছিলেন, করোনার ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতি করলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। প্রয়োজনে বরখাস্ত ও ফৌজদারি মামলা করা হবে।

কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দুঃখ করে প্রথম আলোকে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা কেউই বরখাস্ত থাকবেন না। ইতিমধ্যেই কেউ আদালতের নিষেধাজ্ঞা এনেছেন। কিছু মামলায় কেউ জামিন নিয়েছেন অথবা পুলিশ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

বিভাগটির জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ১৮ জুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনিক তদন্তে এখন পর্যন্ত ১০০ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় এই সংকটকালেও এমনটা হওয়া খুবই বেদনাদায়ক।

>

করোনাকালীন ত্রাণ নিয়ে চুরি-স্বজন-প্রীতির কারণে স্থানীয় সরকারের ১০০ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মন্ত্রণালয়। তাতেও অনেকে দমছেন না।

তদন্ত বলছে, এই জনপ্রতিনিধিরা চাল চুরি, ত্রাণ লুট ও উপকারভোগীদের তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম করেছেন। তাঁরা ওএমএসের চাল নয়ছয় করেছেন, চালের কার্ড দেবেন বলে টাকা নিয়েছেন, খাদ্য সাহায্য চাইতে আসা মানুষদের মারপিট করেছেন। তাঁদের ৬৪ জনই ইউপি সদস্য। ইউপি চেয়ারম্যান আছেন ৩০ জন। বাকিরা পৌর কাউন্সিলর, জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত হয়েছে, কারণ দর্শানোর নোটিশ গেছে। এখন সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী ব্যবস্থার প্রক্রিয়া চলছে। তাঁরা যেহেতু পদে নেই, এ সময় সে পদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন না।

তথাপি তাঁরা তৎপর

হবিগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ভাতিজা আনোয়ার হোসেন সদ্য বিদেশফেরত। সাফিল হোসেন, নবীর হক ও আক্তার হোসেন চেয়ারম্যানের পরিচিত ব্যবসায়ী ও স্বজন। প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার তালিকায় ৩০৬টি নামের পাশে তিনি এই ৪ জনের মুঠোফোন-ব্যাংক নম্বর দিয়েছিলেন। এগুলোতে মোট টাকা যেত ৭ লাখ ৬৫ হাজার।

১৯ জুন মুঠোফোনে রফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর এখন তিনি ঢাকা থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এলাকায় যাওয়া-আসা করেন। সেখানে কাজ সামলাচ্ছেন ওই চারজন এবং ইউপি সচিব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তদন্ত বলছে, বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া নগদ সহায়তার তালিকায় স্বজন, প্রবাসী ও বিত্তবান ব্যক্তিদের নাম ঢুকিয়েছেন। তাঁর সাময়িক বরখাস্তের আদেশ উচ্চ আদালত এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। একই সুযোগ নিয়েছেন নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান কবীর আহমেদ।

মকবুল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁর বিরুদ্ধে ওএমএসের তালিকায় একটি সচ্ছল পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনসহ ১৫ জনের নাম ওঠানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন।

এই পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম তাঁর তালিকায় নিজের দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাতিজা ও চাচাতো ভাইবোন মিলিয়ে ১৬ স্বজনের নাম তুলেছিলেন। আরও ১৭টি নাম ছিল সচ্ছল ও প্রবাসী ব্যক্তিদের।

মকবুল ও রফিকুল দুজনই এলাকায় আছেন। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, বরখাস্ত হওয়ার পরও মকবুল ওএমএসের তালিকার জন্য এলাকার হতদরিদ্র মানুষজনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করে অন্যান্য কাউন্সিলরের মাধ্যমে জমা দিয়েছেন। রফিকুলের ওয়ার্ডের তিন বাসিন্দা বলেছেন, তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের এনআইডি নিয়ে তালিকা তৈরি করছেন।

মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে ডাকলে তবে তিনি যাচ্ছেন। আর রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগে যেভাবে সহযোগিতা করেছি, এখনো সেভাবে করছি। বলতে পারেন ব্যস্তই আছি।’

হবিগঞ্জের জেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের তদন্ত বলছে, রাজিউরা ইউপি সদস্য শফিউল ইসলাম ওএমএসের ৮৫টি কার্ড গায়েব করে দিয়েছেন। অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিরা নানাভাবে অভিযোগ অস্বীকার করছেন। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুস সালাম যেমন প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি ফেঁসে গেছেন। কারণ দর্শিয়ে এখন তিনি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।

নাটোরের লালপুর উপজেলার অর্জুনপুর-বরমহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তার মাস্টার সাময়িক বরখাস্ত হন কৃষক শহিদুল ইসলামকে নির্যাতন করার দায়ে। শহিদুল ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে ত্রাণ চেয়েছিলেন। চেয়ারম্যান গত ১২ এপ্রিল এক ইউপি সদস্যসহ দুজনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নির্যাতন করেন।

পুলিশ ১৭ এপ্রিল চেয়ারম্যানকে আটক করে। পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। এলাকায় আছেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

স্বপদে ফিরে আসা

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হালিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান মো. কাজল ভূঁইয়া ও নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউপির চেয়ারম্যান মো. আনোয়ারুল হক উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট গত সপ্তাহে তাঁদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন।

দুজনের পক্ষেই লড়েছেন আইনজীবী উম্মে কুলসুম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভার্চ্যুয়াল শুনানি হয়েছে। আদালত স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে বলেছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে তাঁর মক্কেলদের সাময়িক বরখাস্ত করার কারণ জানাতে। আইনজীবী বলেন, এ সময় তাঁর মক্কেলরা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

কাজল ভূঁইয়া বাজিতপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আনোয়ারুল হক জেলা কৃষক লীগের নির্বাহী সদস্য। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নিজের দলেরই আরেকজন। এ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা এলাকায় থাকেন না। উপজেলা দুটির নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) স্থানীয় সরকার বিভাগে লিখিত অভিযোগ করেন। তাঁরা ২ জুন সাময়িক বরখাস্ত হন।

কাজল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁকে হেনস্তা করা হচ্ছে। আর আনোয়ারুল হক বলেন, করোনাকালে তিনি অসহায় মানুষদের ঘরে ঘরে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছেন। এলাকায় না থাকা এবং ত্রাণে সহযোগিতা না করার অভিযোগ সঠিক নয়।

পুলিশ ও দল

নাটোরের সিংড়া উপজেলার শুকাশ ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহীন শাহ সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন, মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে হাজতে আছেন। তবে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে জেল থেকে বেরিয়ে আসার নজিরও আছে।

পাবনা জেলায় র‌্যাব ১২ ক্যাম্পের কাছে খবর এসেছিল, বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউপি চেয়ারম্যান কোরবান আলী সরদার ভিজিএফের ২২৯ বস্তা চাল ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের বদলে নিজের প্রতিষ্ঠানের গুদামে রাখছেন। র‌্যাবের একটি দল গত ১৩ এপ্রিল রাতে ওই গুদামে হানা দিয়ে চালসহ চেয়ারম্যানকে আটক করে।

রাতেই র‌্যাব আমিনপুর থানায় মামলা করে। পুলিশ কোরবান আলীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু ১৯ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশ বলে, মামলাটিতে ‘তথ্যগত’ ভুল হয়েছে। চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের আতঙ্কে চেয়ারম্যান নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ইউপির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।

র‌্যাব ১২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চেয়ারম্যানকে আটক ও মামলা করা হয়েছিল। তথ্যগত ভুলের প্রশ্নই ওঠে না।

গত ১৫ এপ্রিল কোরবান আলী সাময়িক বরখাস্ত হন। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এর আগের দিন কেন্দ্রের নির্দেশে জেলা শাখা তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে। উপজেলায় দলের সভাপতি ও পৌর মেয়র আবদুল বাতেন তাঁকে বাঁচাতে তদবির করলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকেও দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এলাকায় ফিরে চেয়ারম্যান কিন্তু সক্রিয় আছেন। এদিকে সাময়িক বরখাস্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিরা ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাবেন। শাস্তিও পাবেন না।