উবার চালাতে পারবে ১৫টি, পাঠাও ২টি

অ্যাপের মাধ্যেম রাইড শেয়ারিং সেবা চালুর অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে তা মাত্র ২৫৫টি গাড়ির। সীমিত সংখ্যায় গাড়ি নামানোর অনুমতির পেছনে শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিই জড়িত নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে রাইড শেয়ারিং সেবার নীতিমালা না মানার কারণেই পুরোদমে এই সেবা চালু করতে পারছে না কোম্পানিগুলো।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) শুধু রাইড শেয়ারিং হিসেবে চালানোর চূড়ান্ত লাইসেন্স আছে—এমন ২৫৫টি গাড়িই চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মেনে সেবা দিতে গেলে উবারের মতো প্রতিষ্ঠান মাত্র ১৫টি গাড়ি চালাতে পারবে। পাঠাও পারবে মাত্র দুটি গাড়ি চালাতে। অন্য কোম্পানিগুলোর ২ থেকে ২০টার বেশি গাড়ি নেই।

করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই স্বাস্থ্যবিধি মানার কড়াকড়ি আছে। এর সঙ্গে সেবাদাতা কোম্পানিগুলোকে নীতিমালা মানার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেছে বিআরটিএ। এতে রাইড শেয়ারিং সেবা কতটা চালু করা সম্ভব হবে, এই নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

ঢাকাসহ সারা দেশে কত গাড়ি ও মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং সেবায় নিয়োজিত, সেই হিসাব নেই বিআরটিএর। একটি যানবাহন মালিক একাধিক কোম্পানির অ্যাপে যুক্ত। তবে রাইড শেয়ারিংয়ে দুই লাখের বেশি গাড়ি ও মোটরসাইকেল যুক্ত বলে মনে করে বিআরটিএ কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে অনেক গাড়ি ও মোটরসাইকেল অ্যাপ ছাড়াই যাত্রী পরিবহন করছে।

উবার–পাঠাও ছাড়া আরও নয়টি কোম্পানির কমপক্ষে ১০০ যানবাহন চালানোর অনুমতি আছে। এসব কোম্পানি মাত্র ১ হাজার ২২৩টি যানবাহনের চূড়ান্ত লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে গাড়ি মাত্র ২৫৫টি। বাকিগুলো মোটরসাইকেল।

বিআরটিএ রোববারের নির্দেশে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি দেয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সহজ ডটকম ও পাঠাও যৌথভাবে আজ সোমবার বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছে। তারা মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি চেয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে লাইসেন্স পাওয়ার পদ্ধতি আরও সহজ করার দাবি জানিয়েছে।

এ বিষয়ে সহজ ডট কমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা এম কাদির প্রথম আলোকে বলেন, করোনা দুর্যোগে নিম্নবিত্ত মানুষের যাতায়াতের মূল ভরসা মোটরসাইকেল। কম টাকায় চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল খুবই উপকারী। এটা বন্ধ রাখলে হবে না। মোটরসাইকেল চালু করে দিতে হবে। সেই দাবিই তাঁরা জানিয়েছেন।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, কেউ তাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালালে তাদের ধরার কোনো পথ নেই। তবে রাস্তায় নেমে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা পরীক্ষা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

রাইড শেয়ারিং কোম্পানির নীতিমালা অনুসারে, প্রথমে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তালিকাভুক্ত হতে হবে। এরপর প্রতিটি যানবাহনের জন্য আলাদা আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি কোম্পানির অন্তত ১০০টি লাইসেন্স করা যানবাহনের একটি ফ্লিট থাকতে হবে।

রাইড শেয়ারিং সেবা চালু আছে প্রায় সব কোম্পানিই তাদের লাইসেন্স নিয়েছে। কিন্তু তাদের অধীনে চলাচলকারী সব যানবাহনের লাইসেন্স নেয়নি। এ জন্যই এখনকার এই জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে রাইড শেয়ারিং সেবার অনলাইনভিত্তিক লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়। ১৩টি কোম্পানি আবেদন করে। এর মধ্যে উবার, পাঠাও, সহজসহ ১২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সনদ পায়।

সরকার সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর উবার ও পাঠাও ১ জুন স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের সেবা চালুর বিষয়ে বিআরটিএতে চিঠি দেয়। জবাবে বিআরটিএ রাইড শেয়ারিংয়ে ব্যবহৃত সব যানের লাইসেন্স এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক আলোচনার পর গত রোববার শুধু লাইসেন্স করা যান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে বিআরটিএ।

এ-সংক্রান্ত আদেশে বিআরটিএ বলেছে, ‘কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিকালীন রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পরিচালনায় বিআরটিএ থেকে রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাপস ব্যবহার করে শুধু রাইড শেয়ারিং মোটরযান এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স (মোটরসাইকেল ছাড়া) স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ২১ জুন থেকে ঢাকা মেট্রো, গাজীপুর মেট্রো, ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলা এলাকায় চলাচলের জন্য অনুমতি প্রদান করা হলো।’

এ ব্যাপারে বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) লোকমান হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি ও নীতিমাল দুটিই ভালোভাবে মেনে চালাতে হবে। এ শর্তেই তাদের সেবা চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

রকারকে ফি না দিতেই কি লাইসেন্স নিচ্ছে না
কোম্পানির অধীনে পরিচালিত প্রতিটি যানবাহনেরও চূড়ান্ত লাইসেন্স নিতে সরকারকে এক হাজার টাকা ফি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। বছর বছর তা নবায়ন করতে হয়। আর এটি মূলত যানবাহনমালিকের দায়িত্ব। রাইড শেয়ারিং কোম্পানি তা নিশ্চিত করেই গাড়ি নামতে দেওয়ার কথা।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, সারা দেশে কত যানবাহন রাইড শেয়ারিংয়ে চলছে, এর প্রকৃত হিসাব তাদের কাছে নেই। একই গাড়ি একাধিক কোম্পানির অ্যাপসে নিবন্ধন করা আছে। তবে সংখ্যাটা দেড় লাখের কম হবে না। প্রতিটি যানবাহন লাইসেন্স করালে বছরে এই খাতে সরকার দেড় কোটি টাকা রাজস্ব পেতে পারে।

দীর্ঘদিন ধরেই চূড়ান্ত নিবন্ধনের বিষয়ে তাগাদা দিয়ে আসছিল বিআরটিএ। আর এ কাজটি সহজ করতে পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এর জন্য কোনো দুর্ভোগ পাহাতে হয় না। এই সেবায় কোনো ধরনের অনৈতিক লেনদেনেরও সুযোগ নেই। এরপরও এক বছর সময় পেয়ে নিবন্ধন না করার পেছনে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াই মূল লক্ষ্য হতে পারে বলে বিআরটিএ কর্মকর্তারা মনে করছেন।

২০১৬ সালে উবার প্রথম ঢাকায় রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে। তখন বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বা নীতিমালা ছিল না। এ জন্য প্রথমে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর স্থানীয় কিছু কোম্পানিও রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে। পরে মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সরকার ২০১৮ সালে নীতিমালা প্রণয়ন করে।

অবশ্য পাঠাও-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হুসাইন এম ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি যানবাহনের লাইসেন্স নেওয়ার তাঁরা সময়ই পাননি। এ ছাড়া অনলাইনে যে প্রক্রিয়ায় এ কাজটি করা হয়, তা খুবই ধীরগতির। আর বিআরটিএ হঠাৎ কঠোর অবস্থানে চলে গেছে। তাঁদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া দরকার।

কোন কোম্পানির কত গাড়ি
বিআরটিএ থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি কোম্পানি রাইড শেয়ারিং সেবা পরিচালনা করার অনুমোদন পেয়েছে। গত ১৬ মে পর্যন্ত ১১টি কোম্পানি সর্বনিম্ন ১০০ মোটরযানের ফ্লিটের নিবন্ধন নিয়েছে। সব মিলিয়ে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১ হাজার ২২৩। এর মধ্যে মাত্রা ২৫৫টি গাড়ি। বাকি ৯৬৮টি মোটরসাইকেলের। সরকার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য শুধু গাড়িগুলো চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। মোটরসাইকেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিআরটিএর তথ্যমতে, ১৬ মে পর্যন্ত সর্বাধিক উবার নিবন্ধন নিয়েছে ১২৬টি যানবাহনের। এর মধ্যে গাড়ি মাত্র ১৫টি। বাকি ১১১টি মোটরসাইকেল। পাঠাও লিমিটেড অনুমতি নিয়েছে ১১৮টি যানবাহনের। এর মধ্যে মাত্র দুটি গাড়ি। বাকিগুলো মোটরসাইকেল। অর্থাৎ এই দুটি কোম্পানি এখন মাত্র ১৭টি গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে। অথচ তাদের অ্যাপে কয়েক হাজার করে গাড়ি নিবন্ধন করে আছে। লকডাউনের আগে সেগুলো চলেছেও।

বিআরটিএ তথ্য বলছে, সহজ লিমিটেড চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়েছে ১০২টি যানের। অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে পিকমি (১০৫টি), কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (১০৬টি), ওভাই সলিউশন লিমটেড (১১১টি), চালডাল লিমেটেড (১১২টি), সেজেস্টা লিমিটেড (১০৪টি), আকাশ টেকনোলজি লিমিটেড (১০৩টি), ইজিয়ার টেকনোলজিস লিমিটেড (১০৩টি), আকিজ অনলাইন লিমিটেড (১২৩টি)।
বডি লিমিটেড চূড়ান্ত অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রবাহন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, তারা শুধু নিবন্ধিত যে গাড়িগুলো রাইড শেয়ারিংয়ের অধীনে চালাতে বলেছে, সেগুলোর প্রতিটির নিবন্ধন নম্বর বিআরটিএতে রক্ষিত আছে। তবে কেউ যদি বাড়তি গাড়ি চালায়, তাতে তাদের ঠেকানোর ক্ষমতা নেই। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট রাস্তায় নেমে কোনো গাড়িতে উঠে যদি পরীক্ষা করে দেখে যে এটির নিবন্ধন নেই, সে ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।