একদিন পৃথিবী শঙ্কামুক্ত হবে

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এইতো জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ শঙ্কামুক্ত ছিল। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই শঙ্কামুক্ত ছিল। করোনা নামক ভয়ংকর ভাইরাসের থেকে মুক্ত ছিল। চীনের উহান থেকে ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে কে জানত। ভেবেছিলাম প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ষা বরণ করব। খোলা আকাশের নিচে বান্ধবীদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব। নীল পোশাকে অনেক ফটো তুলব। সেগুলো টাইমলাইনে বরাবরের মতো আপলোড দেব। কিন্তু,করোনা নামক এ ভাইরাসটির জন্য কিছুই করা হলো না। হোস্টেলে থাকা অবস্থায় কত প্ল্যান করেছি।


প্রতিবছরের জুনে সেমিস্টার শেষ হয়, তারপর ছুটি। আর এই ছুটিতে গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি আসে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমিও প্রতিবছরের জুনে বাড়িতে আসতাম। কলেজের বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতাম। পদ্মা নদীর পাড়ে বাড়ি হওয়ার সুবাদে পদ্মার স্বচ্ছ জলের ছোঁয়া নিতে কখনো ভুল হতো না। কয়েকজন বান্ধবী মিলে পদ্মার পাড়ে বসে স্নিগ্ধ হাওয়া খেতাম। রক্তিম সূর্য অস্তমিত হওয়া উপভোগ করতাম। দুরন্ত কিশোরদের গোসলের ছবি ক্যামেরাবন্দী, ঝালমুড়ি, ফুচকা খাওয়া আরও কত কী না করতাম।

কিন্তু, এবার ১৬ মার্চ করোনা নামক ভয়ংকর ভাইরাসের ভয়ে বাড়ি চলে আসতে হয়। বাড়ি এসে তিন মাস ঘরবন্দী। মাঝেমধ্যে বিষণ্ন হয়ে বাইরে বের হতে চাইলে বাবা-মা বলেন, ঘরে থাকো বই পড়ো, অনলাইনে ক্লাস করো, টিভি দেখো, নামাজ–কালাম পড়ো। বাইরে করোনা ওত পেতে আছে। বাইরে গেলেই শক্ত করে ধরবে। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো মা–বাবার উপদেশ শুনে, কোয়ারেন্টিনে থেকে বেশ কিছু ভালো বই পড়া হয়েছে। আগে সাহিত্য পড়তে তেমন ভালো লাগত না কিন্তু এই তিন মাসে সাহিত্যের সঙ্গে ভালোই ভাব জমেছে। ‘শরৎরচনা সমগ্র’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’ আরও বেশ কিছু বই পড়া হয়েছে।

অনলাইনেই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাইনি। বাইরের সেই স্নিগ্ধ হাওয়া, নদীর স্বচ্ছ পানি, ঢেউয়ের হিসহিস শব্দ আর বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা—সব যেন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনার জন্য একদিকে মানুষ মানসিক কষ্টে ভুগছে, অন্যদিকে জনজীবনেও নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। তিন মাসেই সবকিছু কেমন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর শঙ্কা বেড়েই চলছে। প্রতিটা খাতেই করোনার প্রভাব দেখা দিয়েছে।

মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে অনেকে। রোজ বান্ধবীদের সঙ্গে ফোন আলাপ থেকেই বুঝতে পেরেছি ঘরবন্দী হয়ে কেউ মানসিকভাবে ভালো নেই। এখন হয়তো খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি, কেন পাখিরা খাঁচায় বন্দী থাকতে চায় না। মুক্ত আকাশে ডানা জাপটে ওড়া যাদের কাজ, তারা কীভাবে খাঁচায় বন্দী থাকতে ভালোবাসবে। ঠিক তেমনই প্রতিদিন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ক্যাফেতে গরম কফিতে চুমুক, মনপুরাতে আড্ডা, লাইব্রেরিতেতে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ঘুমানো, সেলফি তোলা, ঘুরতে যাওয়া—এসবে অভ্যস্ত মানুষগুলো কীভাবে ঘরবন্দী থাকবে? তবু থাকতে হচ্ছে ভয়ংকর করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে থেকেও যেন স্বপ্ন দেখা বাদ যায়নি।

এখনো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পৃথিবী একদিন শঙ্কামুক্ত হবে। আবার, আগের মতো জনজীবন স্বাভাবিক হবে। আগের মতোই পড়াশোনা হবে, লিফটে সিরিয়ালের জন্য লম্বা লাইন হবে, ক্লাস হবে, ঘোরা হবে, গরম কফির কাপে আড্ডা জমে উঠবে। সৃষ্টিকর্তা একদিন পৃথিবীকে ঠিকই শঙ্কামুক্ত করবেন। সেই বিশুদ্ধ বাতাস, শঙ্কামুক্ত শহর সবই ফিরে পাব। আবার স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করব।


*শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। [email protected]