আমাদের সাপ্তাহিক হাটের 'রাজবুক'

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছিলাম। সকালে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস শেষে সবাই একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, সন্ধ্যায় গণরুমে ফিরে সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে কারও ট্রাঙ্ককে একমাত্র বাদ্যযন্ত্র হিসেবে অবলম্বন করে গলা ছেড়ে গান গাওয়া। এভাবেই কাটছিল দিনগুলো। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।

আর পাঁচ-দশজনের মতো আমিও ফিরে এলাম গ্রামের বাড়িতে। এখানে ঢাকার মতো মানুষের মধ্যে ব্যস্ততা নেই, নেই যানবাহনের অবিরত শব্দ কিংবা প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। এখানকার মানুষগুলো বড্ড সাদাসিধে। শহরের কৃত্তিমতা এখানে আজও পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি।

প্রতি বুধবার কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে আমাদের এখানে সাপ্তাহিক হাট বসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এই দিনে গাড়িতে করে পণ্য নিয়ে আসে হাটে বিক্রি করার জন্য।

আমি বাড়ি এসেছি আর বুধবারের হাটে যাইনি এমনটা হয়নি। আমি হাটে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছি মানুষের সরলতা। যার সঙ্গেই যার দেখা হচ্ছে কথা বলছেন, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছেন। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে পরস্পরকে কতবার যে হাসতে দেখেছি! আমার কাছে মনে হয়েছে এই হাটে একমাত্র আমি ছাড়া সবাই সবাইকে চেনে।

কারও মধ্যেই যেন জড়তা নেই। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এটাই বোধ হয় জীবন। এদের অধিকাংশই দিনমজুর কিন্তু এদের জীবনযাপনের সরলতা এদের কি আশ্চর্য প্রশান্তিতেই না ঘিরে রেখেছে!

এবার আর হাটে যাওয়া হচ্ছে না। দেখতে পাচ্ছি না সহজ-সরল হাসিমাখা সেই মুখগুলো। খাওয়া হচ্ছে না আমাদের এই হাটের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। শুধু হাটের দিনেই এটি বিক্রি হয়। একদম গোল কিন্তু সামান্য চ্যাপ্টাকৃতির এই মিষ্টান্নকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘রাজবুক’। গরম গরম রুটির দিয়ে রাজবুক খেতে সে কী স্বাদ!

যদিও বাইরে বের হতে পারছি না ভেবে মনটা খারাপ তবু ভাবি একদিন এই বিষণ্ন সময় কেটে যাবে। আমি আবার হাটে যাব। মানুষের প্রাণখোলা হাসি-উল্লাস দেখে আবার নিজের চোখ জুড়াব।

*শিক্ষার্থী, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, জাহাঙ্গীরনগর