যশোরে 'রেড জোনে' ঢিলেঢালা লকডাউন

করোনায় কয়েকজন ব্যবসায়ী মারা যাওয়ায় খুলনা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি বড়বাজার, কালীবাড়ী, হেলাতলা, ক্লে রোডের আশপাশ এলাকার দোকানপাট ২৬ জুন পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী অর্ধেক শাটার খোলা রেখেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। খুলনা বড়বাজার, ২২ জুন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
করোনায় কয়েকজন ব্যবসায়ী মারা যাওয়ায় খুলনা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি বড়বাজার, কালীবাড়ী, হেলাতলা, ক্লে রোডের আশপাশ এলাকার দোকানপাট ২৬ জুন পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী অর্ধেক শাটার খোলা রেখেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। খুলনা বড়বাজার, ২২ জুন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সোমবার বিকেল সাড়ে চারটা। যশোর সদর উপজেলার উপশহর ইউনিয়ন পরিষদ–সংলগ্ন বি ব্লক বাজারে গিয়ে দেখা গেল, সেলুন-মুদি-চায়ের দোকানসহ অনেক দোকান খোলা। এসব দোকানে মানুষের ভিড়। গল্প-আড্ডাবাজি সমানে চলছে। অথচ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় এই ইউনিয়নকে ‘রেড জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

আজ সোমবার যশোরে রেড জোনের আওতায় পড়া কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউন চলছে ঢিলেঢালাভাবে। লকডাউন হওয়া এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের জন্য প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা খুব কমই মানা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে অবাধে চলাচল করছেন মানুষজন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় যশোরের ৬ পৌরসভার ১১টি ওয়ার্ড ও ৩ উপজেলার ৬ ইউনিয়নকে রেড জোন ঘোষণা করে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। ১৫ জুন রেড জোন ঘোষণা করে পরদিন ১৬ জুন সকাল ৬টা থেকে ঘোষিত এলাকায় লকডাউন কার্যকর করা হয়।

জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের যৌথ স্বাক্ষরে জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রেড জোনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বর্ধিত শিফটে কৃষিকাজ করা যাবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামাঞ্চলে কলকারখানা ও কৃষিপণ্য উৎপাদন কারখানায় কাজ করা যাবে। তবে শহরাঞ্চলে সব বন্ধ থাকবে, বাসা থেকেই অফিসের কাজ করা যাবে, কোনো ধরনের জনসমাবেশ করা যাবে না। কেবল অসুস্থ ব্যক্তি হাসপাতালে যেতে পারবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু জরুরি প্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে। রিকশা, ভ্যান, থ্রিহুইলার, ট্যাক্সি বা নিজস্ব গাড়ি চলাচল করবে না, সড়ক, নদী, রেলপথে জোনের ভেতরে কোনো যান চলাচল করবে না, জোনের ভেতরে ও বাইরে মালবাহী যান কেবল রাতে চলাচল করতে পারবে, এই জোনের অন্তর্গত কেবল মুদিদোকান ও ওষুধের দোকান খোলা থাকবে। রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকানে কেবল হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু থাকবে। বাজারে শুধু প্রয়োজনে যাওয়া যাবে। এলাকার রোগীদের পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। শনাক্ত রোগীরা আইসোলেশনে থাকবেন এবং মসজিদ বা উপাসনালয়ে শুধু প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা (কর্মচারী) অংশগ্রহণ করবেন।

রেড জোন ঘোষিত এলাকার মধ্যে রয়েছে যশোর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড, সদর উপজেলার আরবপুর ও উপশহর ইউনিয়ন, নওয়াপাড়া পৌরসভার ২, ৪, ৫, ৬, ৯ নম্বর ওয়ার্ড এবং অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া, পায়রা ও বাঘুটিয়া ইউনিয়ন। চৌগাছা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড, বেনাপোল পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড এবং শার্শা উপজেলার শার্শা সদর ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা পৌরসভার ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড এবং কেশবপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড। পরে যশোর পৌরসভার ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড, কেশবপুর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড, কেশবপুর উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া এবং অভয়নগর উপজেলার শ্রীধরপুর ও শুভরাড়া ইউনিয়নকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়।

সোমবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে যশোর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়া কাঁঠালতলা মোড় ও চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজারে গিয়ে দেখা গেল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুদি, চায়ের দোকান, মোটরসাইকেলের শোরুমসহ অনেক দোকান খোলা রয়েছে। দোকানে বসে মানুষ সমানে গল্প করছে। আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও লকডাউনের কোনো সাইনবোর্ডও ঝোলানো দেখা গেল না। মানুষজনের চলাচল সীমিত করতে বাঁশ বা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতাও দেওয়া হয়নি।

লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে আমাদের বলা হয়েছে, যে বাড়িতে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, শুধু সেই বাড়ির আশপাশে লকডাউন কার্যকর হবে। অথচ পরে মাইকে বলা হলো, গোটা ওয়ার্ড লকডাউনের আওতায় রয়েছে। আসলে আমরা দাপ্তরিকভাবে সঠিক কোনো নির্দেশনা পাইনি। কীভাবে লকডাউন কার্যকর করতে হবে, তা–ও আমাদের জানানো হয়নি। শুধু ঘোষণাই করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ‘আসলে বিষয়টি নতুন বলে সবারই বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আশা করছি, দু–এক দিনের মধ্যে লকডাউন আরও কার্যকর হবে।’

যশোর পৌর এলাকার ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড, সদর উপজেলার উপশহর ও আরবপুর ইউনিয়নসহ জেলার ৭টি উপজেলার একাধিক জায়গা লকডাউনের আওতায় রয়েছে। এসব এলাকায় কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের জন্য নতুন কোনো কেন্দ্র খোলা হয়নি। সংক্রমণের চিত্র একই রকম রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহের জন্য রেড জোন এলাকায় নতুন করে কোনো কেন্দ্র খোলা হয়নি। তবে লকডাউন এলাকায় কারও পরীক্ষার প্রয়োজন হলে নমুনা সংগ্রহ দল ওই বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে, সেই প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।’

আজ বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, নওয়াপাড়া পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত নওয়াপাড়া বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে বাজারে অনেক লোকের সমাগম। নওয়াপাড়ার বুক চিরে যাওয়া যশোর-খুলনা মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। তবে সংখ্যায় কিছুটা কম। বাঘুটিয়া ও পায়রা ইউনিয়নের লোকজন কিছুটা কম বের হতে দেখা গেছে। চায়ের দোকান বন্ধ। সড়কগুলোতে স্থানীয় যানবাহন চলাচল করছে। ভৈরব নদের নওয়াপাড়া, তালতলা, রাজঘাট, ভাটপাড়া, চেঙ্গুটিয়া, রানাগাতী ও সিদ্দিপাশা খেয়াঘাটগুলোতে নৌকায় পারাপার স্বাভাবিক রয়েছে। তবে লোকজন কম পার হচ্ছেন।

পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিষ্ণুপদ দত্ত বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে লকডাউন মোটামুটি কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়াতে মাইকিং করা হয়েছে। মেম্বারদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড কমিটিগুলো কার্যকর করা হয়েছে। মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন। চায়ের দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে।’

বানীপুর গ্রামের আলিম মোল্যা বলেন, ‘বাঘুটিয়া ইউনিয়নে এক দিন মাইকিং করা হয়েছে। আমরা রেড জোনে আছি, সেটা ইউনিয়নের কমবেশি সবাই জেনে গেছে। মানুষ কম বের হচ্ছেন। তবে হাটবারগুলোতে বেশ লোকসমাগম হচ্ছে।’ বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন, মাইকিং করে ইউনিয়নবাসীদের সচেতন করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর আড্ডা বন্ধ করা হয়েছে। মানুষ কম বের হচ্ছেন। ইউনিয়নে লকডাউন অনেকটা কার্যকর করা গেছে।