মৃত্যু দুয়ারে এলেই বুঝি, জীবন কত প্রিয়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

‘কোভিড-১৯’ ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি ক্লাস লেকচারে শিক্ষকের মাধ্যমে। স্যার বলছিলেন চীনে নাকি একটা ভাইরাস এসেছে। যার কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে এবং সংক্রমিত হচ্ছে শত শত।
খবরটা মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপরও ভাবছিলাম চীন তো অনেক দূর, নিশ্চয় আমাদের এখানে আসবে না।

বাসায় এসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য জানলাম। কীভাবে মানুষে ছড়ায়। দিন যেতে থাকল, প্রতিদিন সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ার খবর শুনতে লাগলাম।

দেখতে দেখতে তার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলো। এরপরের অপ্রিয় গল্পটা সবারই জানা। লকডাউন করে দেওয়া হলো। লকডাউনে রয়ে গেলাম ঢাকাতেই। মা-বোন প্রিয় মানুষদের থেকে দূরে থেকেও মনটা যেন তাদের কাছেই রয়ে গেল। প্রতিদিন খবর জানার চেষ্টায় থাকতাম এই বুঝি একটা স্বস্তির খবর পাব, এই বুঝি শুনব আজকে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য, কেউ বুঝি ফোন দিয়ে জানাবে ‘জানো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে, আর কেউ আক্রান্ত বা মৃত্যুবরণ করবে না।’

কিন্তু না, এমন কোনো খবরই আসেনি। বরং দিন দিন খারাপ খবর শুনছিলাম। বিদেশে অবস্থানরত নিকট আত্মীয়ের আক্রান্তের খবরটা যেদিন শুনলাম, ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল, তার কিছুদিন পর আরেকজন আত্মীয়ের আক্রান্তের খবর।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, বিদায় নিয়েছেন কেউ। একধরনের বিষণ্নতা গ্রাস করতে শুরু করল, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলতে থাকলে মনোবল নষ্ট হবে। বই পড়া, আপুকে সাহায্য করা, ভাগিনার সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করলাম।

কিন্তু ১৫ জুন হঠাৎ করেই আপুর জ্বর এল সঙ্গে সর্দি। বিকেলের দিকে শুয়ে ছিলাম। ভাইয়া (ভগ্নিপতি) এসে বললেন, তোর আপুর সিম্পটম তো বেশি ভালো না। কথাটা শুনে এক মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ঘাম ঝরছিল পুরো শরীর দিয়ে।

বাসার প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে আপু দিন পাঁচেক আগে বাজারে গিয়েছিলেন। সুতরাং প্রথমত এই ভয়টাই কাজ করছিল যে এবার আমাদের পালা নয় তো...?

কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, উঠে বসলাম। প্রাথমিক ঘরোয়া চিকিৎসার সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো। আপুকে আলাদা রুমে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। ভয় পাচ্ছিলাম খুব, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলাম সাহস হারালে চলবে না। মনোবল ঠিক রেখে আপুর যখন যা প্রয়োজন, তার জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সেই সঙ্গে বাসার বাকি তিনজন ও ঘণ্টাখানেক পরপর মসলা চা, লেবুপানি, গরম খাবার, ফল খাওয়া চালিয়ে যাই। সেই সঙ্গে একটু পরপর হাত ধোয়া, ঘর পরিষ্কার রাখা। মোটকথা, প্রাথমিক পরিস্থিতিতে যা যা করণীয়, ভাইয়া আপু আমি সবাই সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেলাম।

প্রথম দুই দিন আপুর জ্বর ছিল অনেক। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভাইয়া জ্বরের ওষুধ দিতেন, যদিও পরে আবার জ্বর আসত। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে আপুর শারীরিক অবস্থা উন্নতি হতে থাকল। এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে পঞ্চম দিন আপু সুস্থ হয়ে উঠলেন। সেই সময়টা যে কী পরিমাণ ভয় আর উৎকন্ঠার মধ্যে কেটেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সেদিনই জানলাম ‘মৃত্যু দুয়ারে এসে দাঁড়ালেই বোঝা যায়, জীবন কত প্রিয়...।’

করোনা কিছু জিনিস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা জানতাম প্রত্যেক ব্যক্তিসত্তার দুটি দিক থাকে, ভালো আর খারাপ। ভালো দিকটা সামনে এলেও খারাপ দিকটা আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়। কিন্তু করোনা যেন আমাদের সেই অদৃশ্য দিকটাই দেখিয়ে দিচ্ছে। সমাজের লোভী, অমানবিক, হিংস্র মানুষদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসছে সামনে। যারা অসহায় মানুষদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, মুখোশ খুলে দিচ্ছে সেসব নরকীটদের।

আবার অন্যদিকে মহৎ, মানবিক, পরোপকারী, প্রকৃত মানুষদেরও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বিত্তবান অনেকেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সাহায্য–সহযোগিতা করছেন। আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা করছেন, মৃত ব্যক্তির দাফন কিংবা মুখাগ্নি করে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ডাক্তার, নার্স, সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক বিভিন্ন পেশার মানুষজন নিজ নিজ জায়গা থেকে পরের উপকারে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানুষের প্রতি মানুষের এমন নিবিড় ভালোবাসা পৃথিবী যেন এর আগে কখনো দেখেনি।

সবার কাছে অনুরোধ করব, কেউ অবহেলা করবেন না, আমার হবে না বা হলে প্রতিরোধ করতে পারব, এমনটা ভাবার কোনো কারণই নেই। কে কখন কোন পরিস্থিতিতে পর্যবসিত হবে, তা কেউ জানে না। সুতরাং সবাই সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন, মনোবল ঠিক রাখুন, মানবিক হোন। আর নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন।
‘এক নতুন পৃথিবী দেখার জন্য হলেও সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন...।’

* শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]