লকডাউনে কষ্টে পূর্ব রাজাবাজারের মানুষ, কমেছে সংক্রমণ

লকডাউন। তাই স্বজনদের সঙ্গে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তাঁরা। ছবি: শেখ সাবিহা আলম
লকডাউন। তাই স্বজনদের সঙ্গে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তাঁরা। ছবি: শেখ সাবিহা আলম

আইবিএ হোস্টেলের ফটকের সামনে মঙ্গলবার দুপুরে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন মিনারা। ছোটখাটো উচ্চতার মানুষ বাঁশের প্রতিবন্ধকের ওপাশটায় কী যেন খুঁজছিলেন উঁকিঝুঁকি দিয়ে। কাকে খোঁজেন—এমন প্রশ্নে চমকে তাকান। বলেন, ওখানকার দুটো বাসায় তিনি ছুটা বুয়ার কাজ করতেন।

পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন আরও সাত দিন বেড়েছে মঙ্গলবারই। কেমন আছেন মহল্লার মানুষ, তা জানতেই ওখানে যাওয়া। স্বেচ্ছাসেবীদের অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথম যাঁর সঙ্গে দেখা, তিনিই মিনারা। লকডাউনে কষ্টে পড়েছেন। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় পরে সারা দেশকে লাল, হলুদ ও সুবজ জোনে ভাগ করে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়া শুরু করে।

স্বজনদের জন্য কাঁঠাল এনে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। ছবি: প্রথম আলো
স্বজনদের জন্য কাঁঠাল এনে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। ছবি: প্রথম আলো

সংক্রমণ সংখ্যা বিবেচনায় গত ৯ জুন মধ্যরাত থেকে ঢাকার প্রথম এলাকা হিসেবে পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউনের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে অবশ্য টোলারবাগে স্থানীয় বাসিন্দারা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় লকডাউন মেনে সফলতা পেয়েছিল।

মিনারা অত কিছু বোঝেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্চের শেষে কাজে যেতে নিষেধ করে দিয়েছিল। জুনের পয়লা তারিখ থেকে যাচ্ছিলাম, ফির লকডাউন দিল। তিন মাসের বাসাভাড়া বাকি পড়িছে।’

কথা বলতে বলতে এই নারী বাসার দিকে এগোন। তখন মহল্লার দুপাশের দোকানপাট বন্ধ। বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে একটা মরা ছুঁচোকে পাশ কাটাতেই দেখা হয় মো. মুনির নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে।

বিধবা মিনারা তখনো বলে যাচ্ছিলেন, গ্রিন রোডের ফল ব্যবসায়ী স্বামীর মৃত্যুর পর বোন-বোনজামাইয়ের সঙ্গে থাকেন। দেখার কেউ নেই। কোনো ত্রাণসামগ্রীও পাননি। অল্পস্বল্প যা জমিয়েছিলেন, ভেঙে ভেঙে খাই-খরচা মিটছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই বিক্রি ভালো এই সবজি বিক্রেতার। ছবি: প্রথম আলো
প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই বিক্রি ভালো এই সবজি বিক্রেতার। ছবি: প্রথম আলো

মুনিরও গ্রিন রোডের ফুটপাতে ফল বিক্রি করতেন। দুই দফায় ১০ কেজি চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ আর দুই মেয়ের জন্য দুধ পেয়েছেন। লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর খবরে বেরিয়ে এসেছেন। ফলমূল নিয়ে ভেতরে বসার ব্যবস্থা নেই? কোনো রকমে না-সূচক মাথা নেড়েই চলে গেলেন। কথা বলতে চাইলেন না আর।

আরও কিছুদূর এগোতে নাজনীন স্কুল। এখানেই করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে দুই সপ্তাহ ধরে। স্কুলের সামনে পুলিশ পাহারা। আর স্থানীয় কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরানের ‘ছোট ভাই’য়েরা। গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে তাঁদের বড় অংশ লকডাউন বাস্তবায়নে তৎপর। তবে কাউকে কাউকে আড্ডা দিতে দেখা গেল। একজনকে দেখা গেল মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যাঁরা, তাঁদের অনেকে কাজ সেরে বাসায় ফিরছেন তখন।

মিনারা তখনো সঙ্গে। সবার কথা শুনছেন। একটা ভবনের নিচে পাওয়া গেল তিনজনকে। তাঁদের একজনের মহল্লাতেই ছোটখাটো দোকান। বেশভূষা দেখে বোঝা গেল নামাজ পড়ে বেরিয়েছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে বললেন, কষ্টে আছেন। মহল্লাতেই দোকান আছে একটা। লকডাউনের পর থেকেই ব্যবসা মন্দা। আলাদাভাবে যখন শুধু পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন হলো, তখন পুরোপুরি দোকান বন্ধ।

বিপদে পড়তে পারেন—এই আশঙ্কা থেকে নাম বলেননি, ছবি তুলতেও রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যবিত্তের জ্বালায় জ্বলতেছি। হাত পাততে পারি না। হটলাইন নম্বর দিছে, এখন আমি কি হটলাইনে ফোন করে খাবার চাইব?’

তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মিনারা চলে যান। ঘটনাস্থলে তখন পুলিশ। লকডাউন বাড়ানোর ঘোষণা আসার পর থেকে পুরো মহল্লার চারপাশে সেনাটহল বাড়ে। জোরদার হয় পুলিশি টহলও।

লকডাউন, তবু অনেকেই বাইরে যেতে চান। ছবি: প্রথম আলো
লকডাউন, তবু অনেকেই বাইরে যেতে চান। ছবি: প্রথম আলো

মিনারার পর সঙ্গী হন নাজমা বেগম। তিনিও গৃহকর্মী। বাসায় আটটি মুখ। পাঁচ সন্তান, এক সন্তানের বউ আবার সন্তানসম্ভবা। তিনি কিছুই পাননি বলে অভিযোগ করলেন।


নাজমা বলেন, ‘করোনায় আর মরুন লাগত না, না খায়াই মইরা যামু।’ তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদপুরে ব্লকের কাজ করে, মেজটা ভ্যান নিয়ে মহল্লাতেই শাকসবজি বিক্রি করত। কাজ বন্ধ। মহল্লায় বেচাবিক্রির কাজ পেয়েছেন বাইরের লোক কিংবা কাউন্সিলরের অনুমোদিত ব্যক্তি।

পাশে দেখাও গেল একটি সবজির ভ্যান। বিক্রেতা জানালেন, বিক্রিবাট্টা বেশ ভালো। নাজনীন স্কুলে গেলে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়। ম্যাজিস্ট্রেট বা কাউন্সিলরের কোনো প্রতিনিধি তখন নেই বলে জানালেন শেরেবাংলা নগর থানার ওই উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল ইসলাম।

নাজমুল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ লোক বের হন এলাকা থেকে। সবাই জরুরি সেবার কাজে নিয়োজিত। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ায় এলাকার লোকজন খেপে আছে, জানেন কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, বেসরকারি চাকরিজীবী যাঁরা, তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন। যদিও সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সব অফিস হয়তো মানতে চাইছে না।

এমন পরিস্থিতির শিকার এক বেসরকারি চাকরিজীবীকেও পাওয়া গেল। ইমন হাসান নামের ওই ব্যক্তির অফিস ধানমন্ডিতে। মার্চের শেষভাগ থেকে অফিসে যাননি, দুই সপ্তাহের লকডাউন জানানোয় বাসা থেকে অফিস করার অনুমতি পেয়েছিলেন। এখন কীভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথা বলবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।

মহল্লা ছেড়ে ফেরার পথে ঊর্ধ্বশ্বাসে একজনকে পার্সেল নিতে প্রতিবন্ধকের কাছে যেতে দেখা গেল। নাম বলতে চাননি। তবে জানতে চাইলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ কি না। নইলে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল কেন।

সংক্রমণ পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, লকডাউন কাজ করেছে। সপ্তাহ খানেক বাড়ানো হয়েছে, কারণ সব জায়গায় তিন সপ্তাহের লকডাউন। তা–ই বলেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এটুকু বলার পর বললেন, সমস্যায় আছেন অনেক। অনেকেই কাজে যেতে পারছেন না, প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়াও কঠিন।

হটলাইন নম্বরে ফোন করে ব্রণের ক্রিম, মধ্যরাতে কোক চাওয়ার খবর প্রচারিত হয়েছে। তাহলে আর না পাওয়ার কষ্ট কেন? বলতেই মন খারাপ করলেন। বললেন, ‘দুই সপ্তাহে হটলাইনে যত ফোন গেছে, তার কত শতাংশ এমন অদ্ভুত আবদার করেছে বলুন তো?’


লকডাউনের পর সংক্রমণ কমেছে

পরীক্ষামূলকভাবে চলা ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের এলাকাভিত্তিক লকডাউনের ১৪তম দিন অতিবাহিত হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। লকডাউন চলবে ২১ দিন। প্রাপ্ত তথ্য চলছে, ছোট এই এলাকাটিতে লকডাউন শুরুর দিকের চেয়ে এখন সংক্রমণ এখন কমছে।


এমনকি আগে যাঁরা আক্রান্ত ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবার লক্ষণ এখন ভালো। অবশ্য লকডাউনের শুরুর দিকে আগে থেকেই আক্রান্ত ওই এলাকার এক ব্যক্তি মারা গেছেন।

মিনারা।
মিনারা।

৪৫ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বাস এই এলাকায় ৯ জুন দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে লকডাউন শুরু হয়। লকডাউন শুরুর সময় এই এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছিলেন ৩১ জন।

লকডাউন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মী আজ প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউন শুরুর পর এই এলাকায় ২০ জুন পর্যন্ত মোট ২০৫ জন নমুনা দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯ জুন পর্যন্ত দেওয়া নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। তাতে মোট ৩৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এই ৩৪ জনের মধ্যে ২৪ জন আক্রান্ত হন ১৪ জুন নাগাদ। বাকিরা এর পর আক্রান্ত হয়েছেন। শেষের তিন দিন রোগী শণাক্ত হয়েছে খুবই কম। এর মধ্যে ১৭ জুন ছয়জন নমুনা দিয়ে পজিটিভ হয় একজনের। ১৮ জুন ২২ জনের মধ্যে সবার নেগেটিভ আসে এবং ১৯ জুন নমুনা দিয়েছিলেন ১৯ জন। এর মধ্যে পজিটিভ হয় দুজনের। অথচ লকডাউনের শুরুর দিকে আক্রান্তের সংখ্যাটি তুলনামূলক বেশি ছিল। যেমন লকডাউন শুরুর প্রথম দিনে ১৫ জনের নমুনা দিয়ে পাঁচজন শনাক্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় দিনে ১৬ জনের নমুনা দিয়ে শনাক্ত হয়েছিলেন সাতজন।

জানা গেছে, নতুন করে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল। শুধু লকডাউন এলাকার মানুষের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্থানীয় নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি বুথ স্থাপন করা হয়।

নাজমা
নাজমা

এ ছাড়া লকডাউন শুরুর সময় যাঁরা আক্রান্ত ছিলেন এবং ১৪ দিন অতিবাহিত হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবার লক্ষণ এখন ভালো বলে জানালেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের ওই কর্মী। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আইসোলেশনে থাকায় বেশির ভাগের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে লকডাউনের শুরুর দিকে আগে থেকেই আক্রান্ত ওই এলাকার একজন ব্যক্তি মারা গেছেন।

এদিকে লকডাউনের ১৪ দিনের মাথায় এসে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সেখানে গিয়ে ঘোষণা দেন, লকডাউন এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ২১ দিন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউন চলবে।


করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ১ জুন সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সভায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন এলাকাকে লাল (উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ), হলুদ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) ও সবুজ (নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ) এলাকায় ভাগ করে ভিন্নমাত্রায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলকভাবে লকডাউন শুরু হয়।