সমন্বয়হীন কাজে ফল আসবে না

সৈয়দ আব্দুল হামিদ
সৈয়দ আব্দুল হামিদ

দিন দিন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। এ মাসের মধ্যেই হয়তো সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দেড় লাখে পৌঁছে যাবে। এমন পরিস্থিতিতেও সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। যে কারণে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আশানুরূপ কোনো ফলও আসছে না। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি কৌশল বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

প্রথম কৌশল হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। সংস্থটির পরামর্শ পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) পাঠানো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়তো পরীক্ষা ও চিহ্নিতের কাজটি করতে পারে। কিন্তু আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। কারণ, শনাক্ত সবাইকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারত।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও দূরদর্শিতার অভাব ছিল। তারা হয়তো ভেবেছিল, রোগটি মার্স বা সার্সের মতো আমাদের দেশে আসবে না। ফলে সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়নি। শুরুর দিকে পরীক্ষার ব্যবস্থাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) তাদের কর্তৃত্বে রাখল, বিকেন্দ্রীকরণ হলো না, অনেককেই রাজধানীতে আনা হলো পরীক্ষার জন্য। কিন্তু পরীক্ষার জন্য যাঁরা এলেন, তাঁরা ঢাকায় রোগটি আরও ছড়িয়ে গেলেন। এখনো সবাই পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না।

দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খাতে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা। এর সঙ্গেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জড়িত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী জনবল নিয়োগ করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ কাজটিও সময়মতো হয়নি।

তৃতীয় কৌশলে সামাজিক দূরত্ব ও জনসমাবেশ এড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। এটি না করে সামাজিক দূরত্বের স্লোগান হতে পারত—শারীরিক দূরত্ব ও সামাজিক সংহতি বজায় রাখব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াব। এটি হয়নি বলেই মাকে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে সন্তান। এই কৌশল বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকা উচিত ছিল পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের। এ ছাড়া ভূমিকা পালন করতে পারত ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই কাজটিও ঠিকভাবে হয়নি। ফলে মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানছে না।

চতুর্থ কৌশলে কর্মস্থলে প্রতিরোধ সম্পর্কে বলা হয়েছে। আমাদের দেশে সবার আগে খুলেছে পোশাক কারখানা। তাদের একটি গাইডলাইনও আছে। কিন্তু সেটি কারখানাকেন্দ্রিক। কারও উপসর্গ দেখা দিলে পরের ব্যবস্থাটি কী হবে, তা নেই। ব্যাংকারদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।

পঞ্চম কৌশলে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে একটি থার্মাল স্ক্যানারে শরীরের তাপমাত্রা মাপাতেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল, সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) পাঠানো হয়েছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের উচিত ছিল সবার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা। কারণ, আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোতে হোম কোয়ারেন্টিন সম্ভব নয়।

সবশেষ কৌশলটি হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এটি একসময় সম্ভব ছিল যখন পাড়ায় মুরব্বিদের মানার সংস্কৃতি ছিল। নষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে এটি নষ্ট হয়েছে। এই কাজ করতে পারত স্থানীয় সরকার। কিন্তু দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে ক্ষমতায়িত করা হয়নি।

করোনা একটি যুদ্ধকালীন অবস্থা। তাই সমন্বিত কাজ, যোগ্য ব্যক্তির কাঁধে দায়িত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। না হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।