আবার ফিরে যেতে চাই সুস্থ পৃথিবীতে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মানুষ নিতান্তই প্রকৃতির কাছে অসহায়। কেন বললাম এই কথাটা, কারণ বর্তমান এই করোনা পরিস্থিতি। প্রকৃতি চাইলে কী না পারে, একটু ভাবুন তো এই তিন থেকে চার মাস আগেও আমরা স্বাধীনমতো ঘরের বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছি, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে গিয়েছি। কিন্তু কোভিড–১৯ নামের এক ভাইরাসটি মূহূর্তের মধ্যে সবকিছু কেমন করে যেন চার দেয়ালে আবদ্ধ করে দিল আমাদের। চারপাশে শুধু মৃত্যুর আহাজারি। কে জানে, হয়তো এই করোনা আমাকেও তার মৃত্যুর খেলাতে যোগ করে নেবে। নিজের সম্পর্কে এ কথা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয় বর্তমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে।

ভালোই তো ছিলাম, শীতের ছুটি শেষ করে জানুয়ারিতে ঢাকায় এলাম। অন্য বছরের মতো এ বছরটা একটু অন্য রকম ছিল আমার কাছে। কেননা, এ বছর আমি অনার্স চতুর্থ বর্ষে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক ধাপ পার হওয়ার সময়। তাই এ বছরটা নিয়ে পরিকল্পনার শেষ ছিল না। বন্ধু-বান্ধবীদের একসঙ্গে অনার্স–জীবনের শেষ পয়লা বৈশাখ, বর্ষাবরণ পালন করব, কিন্তু হলো কই আর? সময়টা ভীষণ হিংসুটে, হঠাৎ করেই করোনা নামক কালো আঁধার সব পরিকল্পনা শেষ করে দেবে, তা তো আমার কল্পনায় ছিল না।

এই তো সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহপাঠীদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘পরীক্ষা ছাড়াই একটা সেমিস্টারের ইতি ঘটল’—এই বিষয়ে তাদের অনুভূতি কেমন? সহপাঠীদের বক্তব্য অনুযায়ী অনুভূতির কথা কী আছে আর বলার, দীর্ঘ সময় যদি স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে থাকতে হয়, তখন অনুভূতিগুলোও মরচে পড়ে যায়। সব সময় নতুন একটা সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করার একটা অন্য রকম আগ্রহ কাজ করত। কিন্তু এ বছরটা একটু ব্যতিক্রম। কেননা, নতুন সেমিস্টারটাও অনলাইনে শুরু করতে হবে। কোনো কিছুর ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। তাই এই পরিস্থিতিকে আমি আমার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই না। তবে এটাকে একটা দুর্বিষহ অধ্যায় বলা যায়। চতুর্থ বর্ষটা এমন সাদামাটাভাবে যাবে, তা আসলে আমার চিন্তার বাইরে ছিল। ভবিষ্যতে কখনো হয়তো ডায়েরির পাতায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ বর্ষের কোনো স্মৃতিময় আবেগঘন অভিজ্ঞতাকে ঠাঁই দিতে পারব না। তবে এই দুর্বিষহ করোনাকালীন গৃহবন্দী জীবনের কথা হয়তো ঠাঁই পাবে, যা আমার মনের খোরাকের বিপরীতে অবস্থান করবে সব সময়।

সাড়ে তিন মাস হলো নিজের বাসায় কোয়ারেন্টিন জীবন পার করছি। ঘরের চার দেয়ালে বসে থাকা যায় আর কত! মা–বাবা বলে নামাজ পড়, বিসিএস এবং সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নাও। মা–বাবার কথামতো নিয়মিত ছয়-সাত ঘণ্টা করে বিসিএস এবং সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছি ঠিক আছে, কিন্তু তারপরও এই আবদ্ধ জীবনে প্রতিনিয়তই যেন নিজের জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে অনুভব হচ্ছে।

আবার কবে ফিরে যাব আমার সেই সুস্থ পৃথিবীতে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলো খুব মিস করি, কবে আবার অনলাইনের ভার্চ্যুয়াল ক্লাস থেকে বের হয়ে সেই চিরাচরিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ফিরে যাব, আমার সহপাঠীদের সঙ্গে বসে ক্লাস করব, আবার একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে কফির আড্ডা হবে। জানি না, এই অনিশ্চিত বিভীষিকায় সময়গুলো কবে পার করতে পারব। কবে ফিরে যাব আমি আমার সেই সুস্থ আনন্দঘন পৃথিবীতে, যেখানে থাকবে না মৃত্যুর মিছিল, যেখানে থাকবে না হাজার হাজার মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা।

* শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। [email protected]