দুবারের বেশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত নয়

জাপানের জাইকা প্রণিত মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল তা উচ্চাভিলাষী ছিল। প্রকৃত চাহিদা থেকে প্রাক্কলন অনেক বেশি করা হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। আর সে কারণেই বাড়ছে বিদ্যুতের লোকসানি। পরিকল্পনায় থাকা কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজন নেই। আর সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে নিজস্ব দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ওপর জোর দিতে হবে। নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা গেলে কম দামে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।

আজ বুধবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘কোভিড-১৯ ও বাজেট ২০২০-২১ পর্যালোচনা: বিদ্যুৎ খাতে বণ্টনের অগ্রাধিকার এবং বিকল্প প্রস্তাবনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।

তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের এ দাবির সঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন জাপানের জাইকার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা চাহিদা থেকে বেশিও নয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে জানাশোনা নেই। আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলনের সঙ্গে জিডিপি গ্রোথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি? নতুন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলেও এখনো কেন ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। ব্যয়বহুল এই প্রকল্পগুলো দ্রুত অবসরে পাঠানো হচ্ছে না কেন? বিদ্যুতের কত বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে? বিদ্যুতের ব্যবহার বা চাহিদা বাড়াতে সরকারের কী করছে?’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, গ্রীষ্ম ও শীতে চাহিদার মধ্যে চার হাজার মেগাওয়াটের মতো তারতম্য থাকে। এটা একটা বড় সমস্যা। শীতে এই বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যায় কি না, তা দেখতে হবে। চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা খুব বেশি উচ্চাভিলাষী ছিল। মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল বাদে বাকি প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া উচিত। কয়লা আমদানি এক বড় ঝামেলা। এ জন্য দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বছরে একাধিকবার দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকলে তা গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করবে না। বছরে শর্ত সাপেক্ষে দুবারের বেশি দাম বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।

সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব ও বড় প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রয়োজন অনুসারে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা বাতিল করা যেতে পারে। বিশেষ আইন বাতিল করা উচিত। বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগিতামূলক নয়। এটি বাজার চাহিদার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জাইকা প্রণিত মহাপরিকল্পনায় প্রদর্শিত পন্থায় পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ পর্যালোচনা করে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। জ্বালানি মিক্স, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা আরও যুগোপযোগী করা হয়েছে। দেশে বিদ্যুতের কোনো ওভার ক্যাপাসিটি নেই।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, যৌক্তিক ও সহনীয় মূল্যে নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিদ্যুৎ, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ানো যাবে, স্বচ্ছতাও তত বাড়বে। সব স্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। বিল নিয়ে কিছু অভিযোগ এসেছে। স্মার্ট মিটার ব্যবহার করতে পারলে এ অভিযোগ উঠত না। বিল নিয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ যথাযথভাবে সমাধান করা হবে।

আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নেপালের জলবিদ্যুৎ আমরা গ্রীষ্মকালে ব্যবহার করতে পারি। আর শীতকালে নেপাল বা ভুটানের বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকায় আমাদের কাছ থেকে নিতে পারে। এতে উভয় দেশ উপকৃত হবে।’

অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সিপিডিবির ডিসডিংগুইস্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন, স্রেডার সাবেক সদস্য সিদ্দিক যোবায়ের ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইমরান করীম। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।