>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
তিন মাস আগে যখন জ্বরে ভুগছিলাম, তখন ভাইয়া আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, চিন্তা করিস না! ঢাকাতে এখনো সেভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়েনি। খুব মনে আছে কথাটা তৎক্ষণাৎ শুনে মনে বিশ্বাস জন্মেছিল, আর যা–ই হোক, আমার করোনা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সে বিশ্বাসটাই সত্য প্রমাণিত হয়।
এক সপ্তাহকাল জ্বরে ভোগার পর সুস্থ হই। তারপর কিছুদিন ক্লাস করি। হঠাৎ ১৭ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ মার্চের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ। ওদিকে ভাইয়া গেছে নোয়াখালীতে আপুর বাসায়। তাই ওর ফ্ল্যাটে ওঠার শেষ আশাটুকুও উবে গেল। হলে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাড়িতে ফোন দিই। আব্বুর বক্তব্য হলো, সম্ভব হলে যেন আজকেই রওনা দিই। কয়েকজন বন্ধু দেশের করোনা পরিস্থিতি বর্ণনার সময় আশঙ্কা প্রকাশ করছিল দেশের পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে। শিগগিরই নাকি বন্ধ হয়ে যাবে সবকিছু!
কুমিল্লার এক বন্ধু তো রীতিমতো কাকুতির সুরে বলল, বন্ধু! তোমাদের কয়েকজনের বাড়ি তো অনেক দূরে। তাই বেশি অপেক্ষা করা মনে হয় ঠিক হবে না। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। এত কিছুর পর আর মন টিকছিল না হলে। তাই কালবিলম্ব না করে ব্যাগ গুছিয়ে নিই। তারপর মুখে কিছু দিয়ে চার বন্ধু বেরিয়ে পরি হোস্টেল থেকে। গন্তব্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনে পৌঁছে টিকিট মাস্টারের কাছে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের টিকিট চাইতেই সাফ জানিয়ে দেন, একটাও সিট খালি নেই। চাইলে স্ট্যান্ডিং টিকিট নিতে পারেন।’ অগত্যা স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটে ট্রেনের অপেক্ষা করতে থাকি।
এরই মধ্যে নাশতা সেরে নিই সবাই। এবং রাতের খাবার প্যাকেটজাত করে প্ল্যাটফর্মে বসে দীর্ঘ একটা ঝুটঝামেলা পাড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। অবশেষে ট্রেন এল সময়মতো। ট্রেনের ভেতরে অর্ধেক রাত একবার বসে একবার দাঁড়িয়ে কেটে গেল। জয়পুরহাট পার হওয়ার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। সিট পেয়ে গেলাম সবাই। সিট পাওয়ার আনন্দে অর্ধেক রাতের কষ্ট গ্লানি সব দূর হয়ে গেল। পরের দিন সুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি পৌঁছি।
তারপর দ্রুতগতিতে করোনা দেশে-বিদেশে বিস্তার লাভ করল। অনেকে আটকে গেল শহরে-বন্দরে, দেশে-বিদেশে। আমি তখন আল্লাহর কাছে বারংবার শুকরিয়া আদায় করছিলাম সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারায়।
বলছিলাম বাংলাদেশে করোনা আগমনের প্রাক্কালে ঘটা কিছু কথা। মানুষ একে একে পরিচিত হয়ে গেল কোয়ারেন্টিন, হোম কোয়ারেন্টিন, লকডাউন শব্দগুলোর সঙ্গে। ঘটে গেল অনেক কিছু। এখনো ঘটেই চলছে কালের এই বর্বরতা। পৃথিবীবাসী সাক্ষী হলো আরও একটি কালো অধ্যায়ের। সবার কামনায় শুধু এই ঘন কালো অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ লাভ করার আকুল মিনতি। কিন্তু মানুষ্যকুল তার পরিবর্তে নিত্য দেখে যাচ্ছে মানবতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর দৃশ্যপট। যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার পরিবার চেনে না। মরণের পর দেহগুলো যেন হয়ে যাচ্ছে সরকারি সম্পত্তি, যা ব্যক্তির কাছের মানুষগুলোও ছুঁইতে ভয় পায়। যেন কেয়ামতের আগেই আরেক কেয়ামত!
বেশ কিছুদিন আগে একটি চীনা বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে আসে। ২১ জুন বিশেষজ্ঞ দল সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে চীনা দূতাবাসের উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ান বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো করোনা সংক্রামণের চূড়ায় পৌঁছেনি।’
এই যদি হয় পরিস্থিতি! আর কত লাশের ওজনে ভারী হবে পৃথিবী? বাঙালি কি রুখে দাঁড়াতে পারবে না সেই চূড়ার সামনে? সেই প্রলয়ংকারী চূড়া! বিধ্বংসী চূড়া!
শিক্ষার্থী: দারুন নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা, ঢাকা। [email protected]