ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে দাফন ও্ সৎকারে দৃষ্টান্ত গাউসিয়া কমিটি

করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার লাশ গোসল দিয়ে ও কফিনবন্দী করে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা। ১১ জুন সকালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা গ্রামে।  ছবি: সংগৃহীত
করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার লাশ গোসল দিয়ে ও কফিনবন্দী করে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা। ১১ জুন সকালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা গ্রামে। ছবি: সংগৃহীত

জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ করোনার উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের বাসায় মারা যান রাউজান পৌর এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ নাসির (৪৫)। গভীর রাতে ছোট্ট দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ গ্রামে নিয়ে আসেন স্ত্রী। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা কেউ ঘর থেকে বের হননি। খবর দেওয়া হলে জানাজা পড়ানোর ভয়ে মসজিদের ইমামও পালিয়ে যান। রাত পেরিয়ে ভোর হলে স্থানীয় পৌর কাউন্সিলরের মাধ্যমে খবর পেয়ে লাশ দাফনে ছুটে আসেন গাউসিয়া কমিটি নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ১০ থেকে ১২ জন স্বেচ্ছাসেবক। সকালে তাঁরা লাশ গোসলের পর কাফন পরিয়ে জানাজা শেষে দাফন করেন। গত ২৯ মের ঘটনা এটি।

১১ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান সুব্রত বিকাশ বড়ুয়া (৬৭) নামের এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হয় গাউসিয়া কমিটির। লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে শেষকৃত্যের সব কাজ করেন এই সংগঠনের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া শাখার কর্মীরা।

ধর্ম–বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে এভাবে দিন–রাত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকারে ছুটে চলেন তাঁরা। করোনাসংকট শুরু হওয়ার পর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সংগঠনটি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৩ জন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষসহ ৩৩২টি লাশ দাফন ও সৎকার করেছে। এর মধ্যে করোনা রোগী ছিলেন ১৫০ জন। বাকিদের উপসর্গ ছিল। সবচেয়ে বেশি ২৩৭ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। ঢাকায় হয়েছে ৫১ জন। এ ছাড়া সিলেট, মৌলভীবাজার, নীলফামারী, লালমনিরহাটেও লাশ দাফন করেন তাঁরা।

>চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় ৩৩২ লাশ দাফন ও সৎকার
ধর্ম–বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে দিনে–রাতে মানুষের পাশে তাঁরা

সংগঠন সূত্র জানা যায়, করোনাসংকটের শুরুতে সংগঠনটির কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত লাশ দাফনকাজের প্রশিক্ষণ নেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সুরক্ষা পোশাক পরে দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়। এ কাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির কোনো স্বেচ্ছাসেবী করোনায় আক্রান্ত হননি।

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, লাশ দাফন ছাড়াও বিভিন্ন জেলা–উপজেলায় প্রায় ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করেছে তারা। গত রমজানে এক লাখ পরিবারে ত্রাণ বিতরণও করে। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ান বাজারের দিদার মার্কেটে। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এই গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেশে ২০০–এর বেশি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।

সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পরিষদের সচিব শাহজাদ ইবনে দিদার জানান, সারা দেশে এই সংগঠন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ করে। দেশের ৫০ জেলায় রয়েছে তাঁদের সংগঠনের বিস্তার। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এই সংগঠনের প্রায় ৭০০ কর্মী করোনায় মৃতদের দাফনে কাজ করছেন।

লাশ দাফনকাজের সমন্বয় কমিটির প্রধান মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে লাশের জানাজা পড়ানোর জন্য ইমামও পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণে বাংলা শিক্ষিত হয়েও তাঁকে ইমামতি করতে হয়েছে। অনেক সময় পিপিই সংকটে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। তিনি মনে করেন, সরকারিভাবে আরও সহযোগিতা পেলে সামনে আরও ভালো কাজ করতে পারবেন।

রাঙ্গুনিয়ার পোমরা ইউনিয়নের মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিকাশ বড়ুয়ার ছেলে তমাল বড়ুয়া বলেন, তাঁর বাবার লাশ গোসল ও শেষকৃত্যের সব কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁদের এই সহযোগিতা তাঁর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।