নতুন রুমে সংসার সাজাতেই এল মহামারি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির নোটিশ এল ১৭ মার্চ। ছাত্র-ছাত্রীরা একে একে হল ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলে। তখন কে জানত এই ছুটিটা এত লম্বা হবে? আজ তিন মাস পরও আমরা কেউ জানি না, এর শেষ কবে? কবে আমরা মুক্তি পাব এই মহামারি থেকে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রিয় বন্ধু-বান্ধবী, চেনা পরিচিত মুখগুলো ফের কবে দেখতে পাব, কেউ জানি না।

এই কর্মহীন গৃহবন্দী জীবনে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। প্রিয় হল! তোমাকে ভীষণ মিস করছি। শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আর স্নেহের জুনিয়রদেরও মিস করছি। জুনিয়রদের কথা ভাবলে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে। ওদের ক্লাস শুরু হওয়ার এক মাসের পরপরই এল এই কঠিন সময়। ফার্স্ট ইয়ারের দুরন্ত আনন্দময় দিনগুলোকে ওরাও নিশ্চয়ই মিস করছে। প্রতিবছরই বেশ আয়োজন করে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। জমকালো মেলা বসে। বিভিন্ন অনুষদের নবীন শিক্ষার্থীরা এটার আয়োজন করে। ওরা এটাও মিস করল।

তবে এই মুহূর্তে নিজেকে সুস্থ রাখাই সবার জন্য জরুরি। মহামারি শেষে আবারও সব আগের মতো হবে—মেলা বসবে, আড্ডা হবে, সন্ধ্যায় টিএসসিতে গানের আসর বসবে।

হলে আমার রুমটাকেও খুব মিস করছি। খুব বেশি দিন হয়নি এই রুমে উঠেছি। নতুন রুমটায় নিজের ছোট্ট সংসারটাকে সাজাতে সাজাতেই চলে এল এই মহামারি। আমার বিছানা, পড়ার টেবিল, চেয়ার, প্র্যাকটিক্যালের খাতা, বইপত্র, বয়ামের রাখা বিস্কুট, চানাচুর—সবই পড়ে আছে অযতনে, অবহেলায়। এত দিনে নিশ্চিত ধুলো জমে গেছে। ঘরের কোনায় কোনায় মাকড়সারা জাল বুনেছে। ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছে কি না, কে জানে? ইঁদুর বালিশ-কাঁথা যদি কাটে কাটুক, কিন্তু আমার বইখাতা আর প্র্যাকটিক্যাল নোটবুক যেন না কাটে। রাতের পর রাত কেটে যায় এই নোটবুক রেডি করতে। এত এত চিত্র আর লেখা, শেষ করা অনেক পরিশ্রমের কাজ। সেই খাতা নষ্ট যদি হয়, আবারও করতে হবে নতুন করে।

ধুলো জমা এসব জিনিসও হয়তো আমাকে মিস করছে। আশায় আছে, কবে ঘরের বন্ধ দরজাটা খুলবে? কবে ঘরের মানুষগুলো ফিরে আসবে? কবে জানালা দিয়ে রোদ এসে তাদের আলস্য ভাঙাবে?

হলের বারান্দায় লাগানো ফুলের গাছ আর হলের নিয়মিত বাসিন্দা বিড়ালগুলো কেমন আছে? পানির অভাবে ফুলগুলো ঝরে পড়েছে এত দিনে। কিন্তু বিড়ালগুলোর কী গতি হয়েছে? হলের নিচে ডাইনিংয়ে রান্না হয়। বিড়ালগুলো সেখান থেকে খাবার খেয়ে বাঁচে। তিন মাস ধরে ডাইনিং বন্ধ। বিড়ালগুলো হয়তো খাবারের আশায় এদিক-সেদিক চলে গেছে। তা গিয়ে থাকলে যাক, কিন্তু বেঁচে থাকুক এটাই চাই। চোখের সামনে এদের বড় হতে দেখেছি, খাবারের অভাবে এদের মৃত্যুও আমার কাছে কম কষ্টের না।

হয়তো অনেক সময় লাগবে, অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই মহামারি একদিন ঠিকই শেষ হবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, দ্রুতই যেন শেষ হয়। আমরা আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চাই, ফিরে পেতে চাই সেই কর্মব্যস্ত জীবনটাকে। যেখানে আছে প্রাণখোলা হাসি, গলা খুলে গান, স্বার্থহীন কিছু সম্পর্ক আর দিলখোলা আড্ডা।

*শিক্ষার্থী, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। [email protected]