করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের ঘাটতি শিগগিরই দূর হচ্ছে না

সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানায় আসছেন অনেকেই। নিকুঞ্জের একটি হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত এক রোগীর জন্য অক্সিজেন নিতে এসেছিলেন এই ব্যক্তি। ফেরার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে।  ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানায় আসছেন অনেকেই। নিকুঞ্জের একটি হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত এক রোগীর জন্য অক্সিজেন নিতে এসেছিলেন এই ব্যক্তি। ফেরার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের ঘাটতি শিগগিরই দূর হচ্ছে না। অক্সিজেনের সংকট কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগ কাজে লাগতে দেড় থেকে দুই মাস বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় অক্সিজেনের সংকট তৈরি হয়েছে।

করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের বড় ভূমিকা রয়েছে। রোগীকে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা সব কোভিড হাসপাতালে নেই। অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীকে সিলিন্ডারের অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এদিকে বাজারে সিলিন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও অক্সিজেন উৎপাদনকারীরা বলছেন, প্রয়োজনের সময় পাওয়া যাবে না বা দাম বেশি হবে—এই আতঙ্কে অনেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে মজুত করেছেন।

চারটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অক্সিজেন তৈরি করে। তারা বলেছে, চাহিদা মেটানোর মতো অক্সিজেন তারা উৎপাদন করছে। কিন্তু ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই।

বর্তমান পরিস্থিতি

আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন জেলায় কী পরিমাণ অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন, তার একটি অনুমিত হিসাব আমরা অধিদপ্তরকে দিয়েছিলাম।’

এপ্রিল মাস থেকেই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে এমন খবর পাওয়া যেতে থাকে। রোগীদের দুর্ভোগের কথা, এমনকি ঠিক সময় অক্সিজেন–সহায়তা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুর খবরও প্রকাশ পায়। হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতির কারণে দেশের একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দুই ভাইকে ভাগাভাগি করে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন মারা যান।

‘হাসপাতালে অক্সিজেন ঘাটতি’ শিরোনামে ২৫ এপ্রিল প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। ওই দিন সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে বলেছিলেন, কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।

ভুক্তভোগীরা ছাড়াও সরকারি একটি দলিল বলছে, দেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের সংকট আছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থে সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা তৈরির একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৮১টি হাসপাতালে তা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে ইউনিসেফ। ওই দলিলে বলা হয়েছে, মারাত্মক ও জটিল কোভিড রোগীর জন্য উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন দরকার। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলো চাপে পড়েছে, এমন অবস্থায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাতে আরও বলা হয়েছে, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কোনো হাসপাতালে অক্সিজেন উৎপাদনের ব্যবস্থা নেই। কোভিড রোগীদের জন্য যে উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন দরকার হয়, তা অনেক মেডিকেল কলেজ ও তৃতীয় স্তরের হাসপাতালেও নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৪ জুনের হিসাব বলছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ আট বিভাগের ১১০টি হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য শয্যা আছে ১৪ হাজার ৬৯০টি এবং আইসিইউ শয্যা ৩৭৬টি। এসব হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ৯ হাজার ৯৭৩টি। কোভিড হাসপাতালগুলো প্রধানত অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর নির্ভরশীল।

অক্সিজেন কেন জরুরি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস ২৪ জুন জেনেভায় আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, মহামারির শুরু থেকেই মারাত্মক ও জটিল রোগীদের অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে। যেসব রোগীর রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, সেই রোগীদের কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষমতা হারায়। তখন বাতাস থেকে পরিমাণমতো অক্সিজেন নিয়ে রক্তে দিতে পারে না। রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্রুত অকেজো হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৫ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন দেওয়া দরকার।’

করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকাতেও অক্সিজেনের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিবিশেষ অসুবিধা বোধ করার আগেই শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। সুতরাং অক্সিজেনের জোর প্রস্তুতি থাকা দরকার।

সিলিন্ডারে সমস্যা

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে সাধারণত ১৫, ৫০ ও ৬৫ লিটারের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো করোনা রোগীর মিনিটেই ১০ লিটার অক্সিজেন দরকার হয়। করোনা রোগীর চিকিৎসায় সিলিন্ডার বেশি কাজেও আসছে না।

অক্সিজেন শেষ হলে সিলিন্ডার পাল্টাতে হয়। সংক্রমণের আশঙ্কায় স্বাস্থ্যকর্মীরা এই পাল্টানোর কাজ করতে কিছু ক্ষেত্রে অনীহা দেখান। সিলিন্ডারে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায় না বলে তা মারাত্মক ও জটিল রোগীর ঝুঁকি বাড়ায়।

অক্সিজেন উৎপাদন

চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত অক্সিজেনের ব্যবসা করতে হলে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে চারটি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন তৈরি করে—লিন্ডে বাংলাদেশ, ইসলাম অক্সিজেন, স্পেক্ট্রা অক্সিজেন ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসেস।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গত তিন মাসে অক্সিজেনের চাহিদা তিন গুণ বেড়ে গেছে। বর্তমান চাহিদা মেটানোর মতো অক্সিজেন তাঁরা উৎপাদন করছেন। কিন্তু সরকারের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে সেই অক্সিজেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

>

মহামারির শুরু থেকেই অক্সিজেনের গুরুত্বের কথা বলা হচ্ছে। গুরুত্ব পায়নি সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। সমস্যা দূর হতে সময় লাগবে।

ইসলাম অক্সিজেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বদরুদ্দীন আল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ১৫, ৫০ ও ৬৫ লিটারের সিলিন্ডারে অক্সিজেন সরবরাহ করেন। এগুলোর দাম যথাক্রমে ১২, ১৮ ও ২২ হাজার টাকা।

উৎপাদনকারীরা বলেছেন, তাঁরা সিলিন্ডারের দাম বাড়াননি। তাঁরা ও তাঁদের ডিলাররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিলিন্ডার সরবরাহ করেন। ডিলাররা নিয়মিতভাবে তাঁদের কাছে খালি সিলিন্ডার ভরতে আসেন। বদরুদ্দীন আল হোসাইন বলেন, একটি সিলিন্ডার পূর্ণ করতে তাঁরা ৩৫ টাকা নেন।

নতুন সংকট

অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত বিস্ফোরক পরিদপ্তর। এর প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিভিন্ন আকারের ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। তবে হাসপাতালে কত আর মানুষের বাড়িতে কত, সেই তথ্য কারও কাছে নেই।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শ্বাসকষ্ট আছে এমন ব্যক্তিরা বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখেন চিকিৎসকের পরামর্শে। এসব ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের কেউ কেউ এর ব্যবহারবিধি জানেন।

একটি বড় প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সিলিন্ডারের গণমজুত হয়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে এটা করেছে। এটা বিপজ্জনক।’

মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ‘দুটি কারণে বিপজ্জনক। মজুত করার কারণে যাঁর দরকার, তিনি পাচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত আপাত–অপ্রয়োজীয় বলে সিলিন্ডার বেশি তাপমাত্রার জায়গায় রেখে দিলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা আছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কী পরিমাণ অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে, তা চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘অক্সিজেন হচ্ছে ওষুধ। অন্যান্য ওষুধের মতো অক্সিজেন ব্যবহারের মাত্রা আছে। যে কেউ এর মাত্রা ঠিক করে ব্যবহার করতে পারবেন না।’

সরকার কী করছে

১৪ জুন একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছিল, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউ যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে না রাখে। বাড়িতে মজুত করার কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যাঁদের দরকার তাঁরা অক্সিজেন পাচ্ছেন না। ফলে অনেকে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, যা উদ্বেগজনক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বাইরে কিছু জায়গায় অক্সিজেনের সমস্যা আছে। ৫৩টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার হাই ফ্লো অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার চেষ্টা চলছে।

হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে উচ্চ প্রবাহে অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। তবে এর জন্য কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা থাকতে হয়। সিলিন্ডার দিয়ে হয় না।

এসব কাজ কবে হবে, জানতে চাইলে আমিনুল হাসান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে শেষ হবে। আর হাই ফ্লো অক্সিজেনের পদ্ধতি কেনার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকার একাধিক হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা করতে ১০০ শয্যার হাসপাতালে লাগে ২ থেকে আড়াই মাস, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ৪ থেকে ৫ মাস আর ৫০০ শয্যার হাসপাতালে ৮ থেকে ৯ মাস।

মার্চ মাসে দেশে প্রথম কোভিড রোগীর চিকিৎসা শুরু হয় রাজধানীর কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। এত দিনেও সেই হাসপাতালে অক্সিজেনের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আর প্রায় দেড় মাস আগে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। গতকাল পর্যন্ত তা শেষ হয়নি।