এসএসসির ফলটা সুস্থ পৃথিবীতে শুনতে চেয়েছিলাম

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

‘শ্বাসকষ্ট; সর্দিজ্বর, অতঃপর করোনা; অবরুদ্ধতা, সর্বোপরি শনাক্ত এবং মৃত্যু’ প্রতিটি শব্দ আতঙ্কের। আতঙ্ক আর ভয়—এ দুটোকে যেন সঙ্গী করে সময় কাটাতে হচ্ছে। একটু একটু করে সময় চলে যাচ্ছে আর আমাদের মতো শিক্ষার্থীরা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। যে সময়টায় আমাদের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে বিশ্ব আলোকিত করার স্বপ্ন দেখার কথা সে সময়টায় আমাদের কিনা করোনার আঘাতে প্রাণ দেওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতে হচ্ছে। আমার, হ্যাঁ, আমার মতোই হাজারো শিক্ষার্থীর সময় নষ্ট হচ্ছে। যা শুধু বাবা-মার জন্য নয় খোদ আমাদের জন্যও যথেষ্ট উদ্বেগের।

আমি সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি। এবার এসএসসির ফলাফল শুনে যখন সবাই খুব খুশি হয়েছিল তখন ভাবছিলাম এই খবরটা আমি একটা সুস্থ পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে শুনতে চেয়েছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম—এই পৃথিবীটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক।

কত প্ল্যান ছিল পরীক্ষার পরের তিনটি মাস ঘিরে। ভেবেছিলাম পুরো অবসরটা কাটাব পাহাড় থেকে সমুদ্র ঘুরে ঘুরে। ইচ্ছে ছিল দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রতিবেশী কলকাতার বাঙালিয়ানাও দেখে আসব। তখন আর কে জানত দেশের সীমান্ত তো দূর বাড়ির সীমানা পেরোনোও কঠোর বারণ হয়ে দাঁড়াবে? আত্মীয়স্বজন ফোনে কথা হলেই বলছে— ‘তোমারই তো সুখ। পড়াশোনা, চাপ কিচ্ছু নেই, সারা দিনটাই অবসর।’ তাদের কে বোঝাবে যে কখনো কখনো টিভি, ল্যাপটপ, ফোন কিংবা অন্য যেকোনো ডিভাইসের শব্দও অসহ্যকর হয়ে ওঠে...আমার কাছে, আমার মতো ‘অতি অবসর’ সুখে ভাসা শত শত শিক্ষার্থীর কাছে।

করোনার কারণে গৃহপরিচারিকাকে বিদায় দিতে হয়েছে আগেই। তাই বাসার সব কাজের চাপ মায়ের ওপরই বর্তায়। কিন্তু পুরো বাসার কাজ একা করা অসম্ভব। অবশ্য মায়েরা তো অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। কিন্তু দুদিন সে হাসি অটুট থাকলেও তৃতীয় দিন মায়ের দুর্বলতা আর মলিন চেহারাটা যেন পুরো বাড়িটাই প্রাণহীন করে দেয়। এ জন্য এই অবসরে মাকে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করি। তাই আমার দিন শুরু হয় অন্যভাবে।

আগে আমাদের বাসায় সকাল শুরু হতো ৭টা বাজে, এই সময়টায় তা দুই ঘণ্টা পিছিয়ে ৯টা হয়েছে। সকালের নাশতা সেরে ভাইবোন ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওদের অনলাইন ক্লাস নিয়ে। বাবা গ্লাভস মাস্ক পরে বেরিয়ে যায় অফিসের জন্য। আমি আর মা মিলে শুরু করি বাসার কাজ। ঘর গোছানো, ঝাড়ু দেওয়া, মোছা এসব করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। করোনাই যেন আমাকে এসব কাজ শেখাল। তারপর গোসল, নামাজ, খাওয়া সেরে একঘেয়ে হওয়ার পালা।

প্রতিদিনকার এই নতুনত্বহীন জীবনে প্রায়ই কান্না পেয়ে যায়। ‘মনে হয় কেন এই শাস্তি?’ ওপরওয়ালার কাছে বিকেলের প্রার্থনা শেষে ভাইবোন বসে তাদের প্রতিদিনের পড়াশোনা নিয়ে। আমাকেও টানে আমার পড়ে থাকা খাতা-কলম। এগিয়ে যাই তাদের কাছে। মনের কথাগুলোতে ভরিয়ে তুলি পাতার পর পাতা। জোর করে হলেও নিরাশা–হতাশাকে দূরে ঠেলে, আশাকে আপন করে নিতে, বিশ্বের প্রতি কাব্যচিঠি পাঠাই—

‘রাতের সময় এগিয়ে যায় ঘুম নামে না চোখে,

রোজই নানা আতঙ্ক জমে ভয়ার্ত এই বুকে।

পুরো বিশ্ব ধুঁকছে যেখানে বিশ্রী একটা রোগে,

প্রতিটি ঘরই ভাসছে সে বানে কাঁদছে আপন বিয়োগে।

চিন্তা সবার আত্মীয়কে নিয়ে; আত্মায় মিশে যারা,

প্রার্থনা শুধু ওপরওয়ালার কাছে চেয়ে; ভালো থাকুক তারা।

কেটে যাক দ্রুত; এই অভিশপ্ত মুহূর্ত; ভয়াল স্বপ্নক্ষণ,

মেনে শত ব্রত; শক্তিমানে অবিরত; করা পুণ্যের পণ।

হাজারো দুশ্চিন্তা বন্দিজীবনে; একে একে ভিড় করে,

পার করা অস্থিরতার প্রতিটি দিনে; যেন আরও বেশি চেপে ধরে।

আক্রান্ত বাড়ে; মৃত্যু বাড়ে; বিশ্ব রূপান্তরী,

প্রতিদিন আরও বেশি শ্বাস হারে; যেন এক মৃত্যুপুরী।

যত দিন যায়; ভাইরাস প্রবল হয়; মানুষ ক্ষমতাহীন,

ভালো থাকা বোধ হয় আর সম্ভব নয়; নিখোঁজ আশার দিন।

তবু বেঁচে থাকতে; প্রিয় মুখে হাসি দেখতে;

আশের খোঁজে দুর্বল মনও হয়ে আছে আনমনা,

তাইতো টিকে যেতে ধরাতে; হচ্ছে বিশ্বাস নিয়ে বলতে—

‘যুদ্ধ শেষে ঠিক একদিন হারবে এ মহামারি করোনা।’

*শিক্ষার্থী: এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়ে উত্তীর্ণ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির অপেক্ষায়। বসুন্ধরা, ঢাকা। [email protected]