ঔষধ প্রশাসনের শর্ত পূরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে গণস্বাস্থ্য

গণস্বাস্থ্য
গণস্বাস্থ্য

ঔষধ প্রশাসনের শর্ত পূরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের গবেষক দলের সদস্যরা। তাঁরা সরকারের বেঁধে দেওয়া নতুন নীতিমালার শর্ত পূরণ করতে চান। এ জন্য তাঁরা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষক দলের সঙ্গে বৈঠক বসতে আগ্রহী। আজ শনিবার তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলতে বিএসএমএমইউর গবেষক দলের কাছে যেতে পারেন।

২৫ জুন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো সফল অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট পরীক্ষার জন্য দুটি গাইডলাইন বা নীতিমালা অনুসরণের কথা গণস্বাস্থ্যের কাছে উল্লেখ করেছে। এর একটি হলো মার্কিন কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থা এফডিএ (ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) নির্ধারিত নীতিমালা, অন্যটি হলো আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড (মান)/গাইডলাইন (নীতিমালা)।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং লাইসেন্সিং অথরিটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান গণস্বাস্থ্যকে দেওয়া চিঠিতে বলেছেন, ওই নীতিমালার শর্ত পূরণ করতে না পারার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটটির নিবন্ধন দেওয়া সম্ভব হলো না।

জেনারেল মাহবুবুর রহমান অবশ্য তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘তবে পরবর্তী সময়ে এই কিটটির উন্নয়নের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সহযোগিতা প্রদান করা হবে।’

গণস্বাস্থ্যের গবেষক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএসহ বিশ্বের সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমর্থিত সর্বজনীন নীতিমালা আইএসও ১৩৪৮৫ অনুসরণ করে কিট তৈরি করেছি। আর মার্কিন এফডিএর যে নীতিমালার কথা এখন বলা হচ্ছে, সেটা মাত্র কয়েক দিন আগেই এফডিএ প্রথম প্রকাশ করেছে।’

যোগাযোগ করা হলে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে গত রাতে জানিয়েছেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চিঠির আলোকে তাঁরা তাঁদের পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখছেন।

ওই নীতিমালা অনুযায়ী, গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিটের
সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) ও নির্দিষ্টকরণের (স্পেসিফিসিটি) ন্যূনতম সীমা বা লেভেল হতে হবে যথাক্রমে ৯০ ও ৯৫ শতাংশ। কিন্তু বিএসএমএমইউর গবেষক দল ১০৯ জন করোনা পজিটিভ রোগীর ওপর অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট প্রয়োগ করে। এতে তারা দেখতে পায়, ৬৯.৭ শতাংশ রোগীর দেহে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি গণস্বাস্থ্যের কিট প্রমাণ করতে পেরেছে। বাকিদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব কিটে ধরা পড়েনি। রোগীর হিসাবে মোট ১০৯ জনের মধ্যে ৭৬ জনের দেহে অ্যান্টিবডি এসেছে। ৩৩ জনের দেহে অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়নি। অবশ্য এই ফলাফলের ভিত্তিতেই বিএসএমএমইউর গবেষক দল প্রকারান্তরে গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিবডি কিটের অনুকূলে মতামত দিয়েছিল। তারা ঔষধ প্রশাসনকে জানিয়েছিল, ‘এই কিট দেশে করোনা রোগের ব্যাপকতা পর্যবেক্ষণে (সেরোসার্ভিলেন্স) দেখার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ, এই কিটের মাধ্যমে ইতিপূর্বে যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এ তথ্য আমাদের কোভিড প্লাজমা বিতরণ, কোয়ারেন্টিন সমাপ্তির সময় নির্ধারণ এবং লকডাউন উত্তোলনের রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

নতুন নীতিমালা অনুসরণের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গণস্বাস্থ্যের কিটের প্রধান উদ্ভাবক ড. বিজন কুমার শীল এবং গবেষক দলের সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত কিটের পরীক্ষা করার সময় উল্লিখিত মার্কিন নীতিমালার কথা তো বিএসএমএমইউর গবেষক দলেরও জানা ছিল না।

‘এখানে মাপকাঠি কী হবে, সেটাই আসল’—মন্তব্য করেন ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার। তাঁর কথায়, ‘এখন যে মার্কিন নীতিমালার কথা বলা হলো, আমাদেরকে কিট উন্নয়নে অনুমোদন দেওয়ার সময় সেটা বলা হয়নি। এমনকি পরে বিএসএমএমইউ তাদের গবেষণা দলের দ্বারা টেস্ট করানোর আগ মুহূর্তে যে প্রটোকল তৈরি করেছে, সেটাও করা হয় আমাদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই।’ তিনি বলেন, সবচেয়ে যেটা অস্বস্তির, সেটা হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কারিগরি কমিটি এবং বিএসএমএমইউর কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের মাপকাঠি ভিন্ন।

অবশ্য ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বাধীন গণস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ দলের কাছে এখন বড় প্রশ্ন হলো, একটি বৈজ্ঞানিক ফলাফলের যথার্থতা পুনরায় যাচাই করা। আজ বা কাল যখনই তাঁরা সুযোগ পাবেন, বিএসএমএমইউর গবেষক দলের কাছে ৭০ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবডি নিরূপণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলেছে, গণস্বাস্থ্যের গবেষক দলের সদস্যরা কিছুতেই ৭০ শতাংশের ফলটা মানতে পারছেন না। সে কারণে তাঁরা বুঝতে চাইবেন, একবার করোনা রোগী হলেই তাঁদের দেহে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া যাবেই, সেটা বিজ্ঞান বলে না। এটা শতভাগ স্বতঃসিদ্ধ নয় যে কেউ পজিটিভ মানেই অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবেই।

উল্লেখ্য, আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে ওই ১০৯ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। তাঁদের প্রত্যেকের অন্তত ১৪ দিন (পজিটিভ শনাক্তের দিন থেকে) পেরিয়ে যাওয়ার পর অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। আর এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে আরটিপিসিআর দিয়ে আসা ফল মোটামুটি ৩০ শতাংশ ভুল আসে। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নেওয়া হয়, ১০৯ জন প্রকৃতই করোনা রোগী, তাহলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরে নেওয়া যাবে না, ১৪ দিন পরে তাঁদের সবার দেহে অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবেই।

ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার বলেন, ওই ৩৩ জনের দেহে কেন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি, সেটা পরীক্ষা করার একটি স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। এর নাম অ্যালাইজা টেস্ট। এই টেস্ট বিএসএমএমইউর নিজেরই আছে। সুতরাং তাঁরা তাঁদের আলোচনায় এই টেস্টের দাবি জানাবেন।

নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে কিটের উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ এফডিএ নীতিমালার শর্ত পূরণের বিষয়টি তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছেন বলে জানান। অবশ্য গণস্বাস্থ্য সূত্র বলেছে, এফডিএর নীতিমালার কথা বিএসএমএমইউর অভ্যন্তরীণ কমিটির জন্য প্রযোজ্য। গণস্বাস্থ্যের গবেষণা প্রসঙ্গে বলা হয়নি।

গণস্বাস্থ্যের গবেষক দলের দাবি, সদ্য ঘোষিত মার্কিন এফডিএর নীতিমালা অনুসারে তারা তাদের কিটের কার্যকারিতা প্রমাণে এখন আরও বেশি আশাবাদী। কারণ নিশ্চিতভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া মাত্র ৩০টি নমুনার বিপরীতে গণস্বাস্থ্যের কিটের কার্যকারিতা এখন প্রমাণিত হলেই চলবে। আর নিশ্চিত অ্যান্টিবডির নমুনা অ্যালাইজা টেস্ট বলে দেবে।