বিষণ্নতায় ঘরবন্দী শিশু, ভেঙে পড়ছে পুষ্টিশৃঙ্খল

করোনার এই পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী থাকতে না পেরে বাসার সামনে খেলছে দুই শিশু। গতকাল বরিশাল নগরের পলাশপুর এলাকায়।  ছবি: সাইয়ান
করোনার এই পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী থাকতে না পেরে বাসার সামনে খেলছে দুই শিশু। গতকাল বরিশাল নগরের পলাশপুর এলাকায়। ছবি: সাইয়ান

বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের মানুষকে দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘর ভাঙে। কিন্তু করোনার মতো অদৃশ্য দুর্যোগে ঘরদোর ঠিকঠাক থাকলেও ওলট-পালট মানুষের জীবন-জীবিকা। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা।

 করোনাকালে পরিবারে খাবার–সংকটে ভেঙে পড়ছে শিশুদের পুষ্টিশৃঙ্খল। স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়ছে আচরণগত পরিবর্তন, বিষণ্নতা। মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ার পাশাপাশি ঝরে পড়াসহ নানা ঝুঁকিতে পড়েছে এ অঞ্চলের অগণিত শিশু।

বরিশাল নগরের আমিরকুটি এলাকার গৃহকর্মী হেনা বেগমের (২৮) মেয়ের বয়স ৫ বছর। রিকশাচালক স্বামীসহ তিনজনের সংসার। আগে স্বামী-স্ত্রী মিলে মাসে আয় করতেন ১০-১২ হাজার টাকা। কিন্তু হেনা তিন মাস বেকার। স্বামীর আয়ও কমেছে। এখন পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বেশি আয় নেই। এ দিয়ে ঘরভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে তিন বেলা খাবার জোটানো কষ্টসাধ্য।

হেনা বলছিলেন, ‘মাইয়্যাডায় একটু মাছ, ডিম খাইতে চায়। কিন্তু পামু কই। প্রায় রাইতেই কাইন্দা ঘুমাইয়্যা যায়।’

শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও চিকিৎসকদের মতে, এ অঞ্চলে যখনই কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, তার বড় ভুক্তভোগী হয় শিশুরা। করোনার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের মধ্যে পুষ্টির চাহিদা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

>দরিদ্র পরিবারে খাবারের সংকট
তিন মাস ধরে স্কুল বন্ধ
ঘরবন্দী শিশুরা বিষণ্নতায় ভুগছে

নগরের উপকণ্ঠে কাশিপুর স্কুল-সংলগ্ন এলাকায় ছোট্ট খুপরি তুলে ১০-১২ বছর ধরে বাস করছে চারটি বেদে পরিবার। মা মায়া বেগম (২২) খুপরির বাইরে ছোট্ট একটা হাঁড়িতে ভাত রান্না করছিলেন। পাঁচ বছরের মেয়ে নিপু খুপরির পাশে রাখা কয়েকটি হাঁড়ির ভেতর খাবার খুঁজছিল। একটি হাঁড়ির সরা তুলে অল্প কিছু পান্তা পেয়ে মুখে ভুবন ভোলানো হাসি তার! এই খুশি বলে দিচ্ছিল প্রয়োজনীয় পুষ্টি আর খাবারের অভাব কীভাবে ওদের বেড়ে ওঠার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নিপুর বাবা ওমর সানি (২৫) চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকেন। আগে স্বামী-স্ত্রী সারা দিন কাজ করে সাত-আট শ টাকা আয় করতেন, এখন টেনেটুনে দুই-আড়াই শ। সানি বললেন, ‘রোজগার কমায় খুব কষ্টে আছি, বাচ্চাগুলারে ঠিকমতো খাওন দিতে পারি না।’

ইউনিসেফের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সাবরিনা রাফি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে শিশুরা। এটা আরও দু-এক মাস দীর্ঘায়িত হলে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার কবলে পড়তে পারে। এতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

খাবারের সংকট

গত কয়েক দিনের লাগাতার বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রোদের ঝাঁজটা ছিল গ্রীষ্মকালের মতো। তেজস্বী সূর্যের উত্তাপে পিচঢালা পথটা তেতে আছে। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক ধরে ২৮ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে কতগুলো বেদে পরিবার চোখে পড়ে। বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর পূর্ব পাড়ে বালুর মাঠে খুপরি ঘর তুলে ৫০টি পরিবারে অন্তত সাড়ে তিন শ মানুষের বাস।

মূল সড়ক থেকে হেঁটে যেতেই বেশ কিছু শিশুকে খোলা মাঠে খেলতে দেখা গেল। ধুলামাখাশিশুদের কারও পরনে ছেঁড়া জামা-কাপড়, কারও পরনে কিছুই নেই। বয়সের তুলনায় এরা খর্বকায় ও লিকলিকে। এদের একজন তামিম (৮) দৌড়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, ‘কারে বিচরান।’ ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সকালে আধপেট পান্তা খেয়েছে। তাদের বাবারা আয়–রোজগারের জন্য সকালেই বাইরে গেছেন। আয় হলে চাল-সওদা নিয়ে আসবেন। ভাত, আলু সেদ্ধ আর পাতলা ডাল—এটাই তাদের প্রতিদিনের খাবার। তা–ও আবার কোনো কোনো দিন ভরপেট নয়। শিশুদের সঙ্গে আলাপের পর খুপরির দিকে এগোতেই দেখা গেল, রুমা বেগম (২৩) তাঁর ৯ বছরের মেয়ের মাথায় বিলি কাটছিলেন। কথার একপর্যায়ে রুমা বেগম বললেন, ‘রোজগার নাই বইল্লা অহন তিন বেলা খাওনেই দায়।’

স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা এবং সিটি এলাকায় ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮টি শিশু (শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী) আছে।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক অসীম সাহা বলেন, শিশুদের পুষ্টির অভাব হলে দৈহিক বিপর্যয় ছাড়াও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে প্রায়ই অসুখ হতে পারে। আর করোনার মহামারির এই ক্রান্তিকালে দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকার জন্য শিশুরা তাদের সহপাঠী, খেলাধুলার সঙ্গীর সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

শিক্ষায় সংকট

নগরের বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়ের বাসিন্দা গৃহিণী ফাতেমা রহমান (৩৫)। স্বামী মাসুদ পারভেজ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার কারণে তিন মাস ধরে বেকার। স্ত্রী ফাতেমা ঘরে বসে নারীদের পোশাক তৈরির কাজ করে টেনেটুনে তিন মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার চালাচ্ছেন। বড় মেয়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মেজ মেয়ে দ্বিতীয় আর ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তিন সন্তানই তিন মাস ধরে ঘরবন্দী। ফাতেমা বলছিলেন, বাচ্চাগুলো তিন মাসের বেশি বাইরের আলো দেখছে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। বেশির ভাগ সময় বিষণ্ন থাকে।

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের শিশু ও তরুণদের ওপর করোনাকালের প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ করেছে। ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এই জরিপ প্রকাশিত হয় গত ২৮ এপ্রিল। এতে বলা হয়, মহামারির সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতনের জন্য সরাসরি তিনটি কারণকে উল্লেখ করেছে শিশুরা। এক. শিক্ষার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, দুই. সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং তিন. পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া। ৭১ শতাংশ শিশু ও তরুণ বলেছে, স্কুল বন্ধের কারণে তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ ভাবছে।

এই জরিপের তথ্যের সত্যতা মেলে জিনাত জাহানের কথায়। নগরের চৌমাথা–সংলগ্ন মুসলিমপাড়া এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি। ১৫ মার্চের পর থেকেই তাঁর ছোট্ট দুই ছেলেমেয়ে ঘরে। চারতলার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দেখা গেল, তাঁর ছয় বছর বয়সী ছেলে তাসিন বারান্দার গ্রিল ধরে উদাস ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাসিন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে। স্কুল বন্ধের পর এক মিনিটের জন্যও সে বাইরে যায়নি। জিনাত হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘জানি না এই অবস্থা কবে শেষ হবে!’

অনলাইন ক্লাস অকার্যকর

বরিশাল জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৫৮২। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৫২। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ বলছে, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদান শুরু হয়েছে। কিন্তু গ্রামের-শহরের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা সে সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। শহরের মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা অনলাইনে পাঠদান সুবিধা পেলেও তাতে স্বস্তি মিলছে না।

গুচ্ছগ্রামের বেশ কজন শিশুকে দেখা গেল রাস্তায় ঘুরতে। মুহিত, সুবর্ণা জিয়াদ, তামিম, রোজী, লাকি—এরা সবাই স্কুলে যায়। কিন্তু স্কুল বন্ধের পর বাড়িতে পড়াশোনাও বন্ধ।

শুধু নগরের নয়, গ্রামের শিশুরাও অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের বেশির ভাগ পরিবারে স্মার্টফোন নেই। আবার সংসদ টেলিভিশনে পাঠদান হলেও টিভি না থাকায় সে সুযোগও মিলছে না।

শুধু প্রাথমিক নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে উচ্চমাধ্যমিকে এবার ৬৯ হাজার ৯৩৮ শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা। গত ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিভাগে ২ হাজার ৭০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ লাখ ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর লেখাপড়াও এখন বন্ধ।

আঘাতের ওপর আঘাত

এমনিতেই দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। দুর্যোগের শিকার এই অঞ্চলের লাখ লাখ শিশু। করোনার সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেই গত ২০ মে ঝড়ের কবল থেকে সুরক্ষা পেতে এ অঞ্চলের লাখ লাখ শিশুকে বাবা-মায়ের সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটতে হয়েছিল। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া, ভয়-শঙ্কা নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করা, আবার বাড়ি ফিরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বসতঘরের দুর্দশা—এসব পরিস্থিতি উপকূলের শিশুদের মানসিক অবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। এতে এসব শিশু মানসিকভাবে আরও বিপদাপন্ন।

বেদে পরিবারের পাঁচ বছর বয়সী শিশু নিপু। আপাতত খেলাধুলা আর ঘরের টুকটাক কাজ করেই তার সময় কাটে। বৃহস্পতিবার বরিশাল নগরের কাশীপুর সেনাপল্লিসংলগ্ন এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বেদে পরিবারের পাঁচ বছর বয়সী শিশু নিপু। আপাতত খেলাধুলা আর ঘরের টুকটাক কাজ করেই তার সময় কাটে। বৃহস্পতিবার বরিশাল নগরের কাশীপুর সেনাপল্লিসংলগ্ন এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের কীর্তনখোলা নদীতীরে চারজনের পরিবার নিয়ে ছোট্ট একটা খুপরিতে বাস করেন মুক্তা বেগম। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্বামী কোনো কাজ করেন না। আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে মুক্তা সংসার চালাতেন। করোনার কারণে সে কাজও প্রায় বন্ধ। মুক্তা বলেন, ‘করোনায় এমনেই ঘরে খাওনের অভাব। হ্যারপর আম্পানে ঘরটুকও ভাঙছে। ছোট্ট বাচ্চাগুলার মুহের দিক চাইতে পারি না।’

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বিভাগে প্রায় সাড়ে ৪৯ হাজার বাড়িঘরের পুরোপুরি ও আংশিক ক্ষতি হয়। ঝড়ের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেতে বিভাগের ১৪ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিল।

সংকুচিত শিশু স্বাস্থ্যসেবা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সাধারণ রোগব্যাধির চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ কম। এরপর মানুষের মধ্যে সংক্রমণের আতঙ্ক বিরাজ করায় এখন আর শিশুদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে না।

বরিশালের বাকেরগঞ্জের পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নের বড় রঘুনাথপুর গ্রামের গৃহবধূ সিমু বেগমের (২৮) পাঁচ ছেলেমেয়ে। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে তিনি দুই যমজ সন্তান প্রসব করেন। নাম রেখেছেন হাসান-হোসেইন। সিমুর স্বামী শামীম হোসেন ঢাকায় কার চালাতেন। করোনায় চাকরি হারিয়ে এখন তিনি বেকার। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সমস্যা হলে সিমু বেগম বাড়ির কাছেই সীমান্তবর্তী পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের চৈতা উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির পর গত তিন মাসে বাচ্চারা অসুস্থ হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাননি। তিনি বললেন, ‘এহন চাইদিকে যে অবস্থা হ্যাতে ছোট্ট বাচ্চাগো লইয়্যা ঘর দিয়া বাইরে নামতে ভয় লাগে।’

একই গ্রামের গৃহিণী ময়না বেগম (২২) তাঁর সাত মাস বয়সী ছেলে মারুফকে নিয়েও ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেন। কিন্তু গত তিন মাসে তিনিও যাননি। ময়নার স্বামী বাবুল ঢাকায় রিকশা চালাতেন। এখন কাজ না থাকায় বাড়িতে আছেন।

উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটির উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো) মিজানুর রহমান বললেন, আগে প্রতি মাসে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে আড়াই থেকে তিন শ শিশু চিকিৎসার জন্য আসত। গত তিন মাসে ৫০-৬০ জনের বেশি আসেনি।

চরাদী ইউনিয়নের গোপালপুর, বলইকাঠি, হলতা, সন্তোষদি ও সাগরদী—এই পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের দায়িত্বে আছেন হেলথ প্রোভাইডার ফারজানা আক্তার। তিনি বললেন, আগে প্রতি মাসে এক শ থেকে দেড় শ শিশু এখানে চিকিৎসার জন্য আসত। এখন ৩০-৪০ জন আসছে। দিন দিন এই সংখ্যা কমছে।

বাড়তে পারে বাল্যবিবাহ

করোনাকালে পরিবারের আয় কমে যাওয়া ও পড়াশোনা থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকায় শিশুরা অপুষ্টি ও একাকিত্ব ছাড়াও নানা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। বাকেরগঞ্জের উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা রিকশাচালক। কিশোরীর দুই মামা ঢাকার পোশাক কারখানায় শ্রমিক। তাঁরা পরিবারের ভরণ-পোষণে কিছু সহায়তা করতেন। কিন্তু এখন তাঁদেরও চাকরি নেই। তাই সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ জন্য বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিশোরী মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরিতে পাঠাবেন। কিশোরী বলল, ‘এটা আমার জীবনের জন্য খুবই এক খারাপ প্রভাব আনবে এবং আমার পড়াশোনার স্বপ্নকে শেষ করে দেবে। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলছি এবং আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। জানি না সেটা কতটা সফল হবে।’ কিশোরীর বাবা বলেন, ‘পড়ামু না খাওন জোডামু। মাইয়্যাডারে পড়ামু, হেই স্বপ্ন দ্যাহনডাই মিছা।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। এতে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার বাড়বে। শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। ফলে শিশুরা শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও পাচারের শিকার হবে। ১০ থেকে ১৮ যে বয়সটা, কিশোর বয়সে যারা আছে, তারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কিশোরীরা বাল্যবিবাহের শিকার হবে। শিশুদের পাচারের আশঙ্কাও বাড়বে।

ইউনিসেফের বরিশাল বিভাগীয় প্রধান এ এইচ তৌফিক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারে খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়া অবশ্যই শিশুদের পুষ্টিশৃঙ্খলে বড় প্রভাব পড়ছে। এতে শিশুদের বিকাশ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি বলেন, ‘মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মানসিক দুর্দশা লাঘবে অভিভাবকদের উচিত শিশুদের যেকোনো উপায়ে সার্বক্ষণিক সক্রিয় রাখা। শরীরচর্চা, সৃজনশীল কাজ, গল্প করাসহ শিশুদের সব ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া। নিম্নবিত্ত পরিবারের বিষয়ে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা চালাচ্ছি।’ (শেষ)