করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

কোভিড-১৯
কোভিড-১৯

করোনা সংক্রমণ অতি দ্রুত বাড়তে পারে—এমন চারটি জেলার ব্যাপারে পূর্বাভাস দিয়েছিল কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল। জেলাগুলো হলো কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রংপুর। ১০০ রোগীর কম আছে এমন জেলাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার কথাও তারা বলেছিল। প্রায় এক মাস পর দেখা যাচ্ছে, চার জেলায় সংক্রমণ বেড়েছে ব্যাপক হারে। রোগী কম থাকা ৩১টি জেলাতেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।

দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে এই পূর্বাভাস দিয়েছে চারজনের কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল। মহামারি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটিকে তথ্য বিশ্লেষণে সহযোগিতা করে আসছে। তাদের এ পূর্বাভাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত এপ্রিল থেকে ব্যবহার করছে।

দেশের বিভিন্ন জেলার সংক্রমণ পরিস্থিতির ওই পূর্বাভাস ৩১ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছিল আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা মনে করেন, সেই পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতেও বলেনি। ৩১ মের পর থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে রোগী বেড়েছে যথাক্রমে ২২৭ ও ২১২ শতাংশ আর রংপুরে বেড়েছে ১০০ শতাংশ। কুমিল্লায় রোগী বেড়েছে ২৫৮ শতাংশ।

পাবলিক হেল
থ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, চারটি জেলায় ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব জেলায় রোগ শনাক্তকরণ, শনাক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) নেওয়া এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ওপর জোর দিতে বলেছিলাম।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগী তো সব জায়গাতেই বেড়েছে। ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থাপনার উন্নতি চোখে পড়বে।’

৪ জেলার পরিস্থিতি

দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ। ৩১ মে পর্যন্ত সারা দেশে রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন ৪৭ হাজার ১৫৩ জন। ২৬ জুন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৪৭৪ জন। অর্থাৎ জুন মাসে রোগী বৃদ্ধির হার ১৭৭ শতাংশ।

>প্রায় এক মাস আগে জেলাগুলোর পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে, তার তথ্য ছিল। সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কুমিল্লা জেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ৯ এপ্রিল। সেদিন থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৫৩ দিনে জেলাটিতে রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৮৪৬ জন। আর জুনের ২৬ দিনে রোগী বেড়ে হয় ২ হাজার ১৪৮ জন, বৃদ্ধির হার ২৫৮ শতাংশ।

গতকাল শনিবার জেলার ১ হাজার ৭৭৮টি নমুনা জমে ছিল। জেলায় রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষাকেন্দ্র একটি। কুমিল্লা শহরের চারটি ওয়ার্ডে ২০ জুন থেকে লকডাউন (অবরুদ্ধ অবস্থা) চলছে, চলবে ৩ জুলাই পর্যন্ত। জেলা সিভিল সার্জন মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আরও একটি পিসিআর যন্ত্র বসানোর চেষ্টা চলছে। তাতে পরীক্ষা দ্রুত হবে। কোনো কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে না।

জানা গেছে, এসব জেলায় বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো নির্দেশনা যায়নি। কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাড়তি কিছু করার নির্দেশ আমরা পাইনি। তবে দেশের যেকোনো জেলার চেয়ে আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বেশি উদ্যোগ নিয়েছি।’

এই জেলায় প্রথম রোগী শনাক্ত হন ২৪ মার্চ। ৩১ মে পর্যন্ত রোগী ছিলেন ৭৩৪ জন। ২৬ জুন রোগী বেড়ে হয় ২ হাজার ৪০১ জন। রোগী বেড়েছে ২২৭ শতাংশ।

সিভিল সার্জন জানান, কক্সবাজার ও টেকনাফ পৌরসভা এবং উখিয়ার তিনটি ইউনিয়নে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে সেখানে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীর কারণে কক্সবাজার অনেক ঝুঁকিতে। এ পর্যন্ত করোনায় পাঁচজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ৪৮ জন। আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসাধীন।

চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম রোগী শনাক্ত হন ৩ এপ্রিল। ৩১ মে পর্যন্ত রোগী ছিলেন ২ হাজার ৪৪১ জন। এর পর থেকে এ পর্যন্ত রোগী ২১২ শতাংশ বেড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম মহানগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ডকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে লকডাউন চলছে। মহানগরের বাকি অংশ ও জেলায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের আর কোনো কাজ হচ্ছে না। কোনো কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, জীবন–জীবিকার বিষয়টি মাথায় রেখে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

রংপুর জেলায় প্রথম রোগী শনাক্ত হন ৮ এপ্রিল। ৩১ মে পর্যন্ত রোগী ছিলেন ৪২৭ জন। এখন হয়েছেন ৮৫৩ জন। রোগী বৃদ্ধির হার ১০০ শতাংশ। রংপুর জেলা সিভিল সার্জন হিরম্ব কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় শুরু থেকে শহরে ও বিভিন্ন উপজেলায় কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছে। এটা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, শহরে একজন–দুজন করে রোগী ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। তাই জোনিং (এলাকা বিভাজন) করা খুব কঠিন। কীভাবে করা যায়, তার বিকল্প খোঁজা হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রণে আসেনি সংক্রমণ

কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাফিউন শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু জেলায় সংক্রমণ বেশি দেখছিলাম। আবার কোনো কোনো জেলায় সংক্রমণ কম ছিল। সংক্রমণ কম থাকা জেলাগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলাম।’

শাফিউন শিমুল ও আবু জামিল ফয়সাল দুজনই বলেছেন, রোগী কম এমন জেলাগুলোতে আইসোলেশন ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা সহজ ছিল। আর সেটা করা সম্ভব হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। কিন্তু কাজগুলো হয়নি।

আইইডিসিআরের ৩১ মের পরিসংখ্যান বলছে, ৩১টি জেলার প্রতিটিতে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ১০০–এর নিচে ছিল। এখন শুধু লালমনিরহাট, মাগুরা, মেহেরপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ্—এই চার জেলায় শনাক্ত রোগী ১০০ এর নিচে।

১৩ এপ্রিল খুলনা জেলায় প্রথম রোগী শনাক্ত হন। ৩১ মে পর্যন্ত খুলনা মহানগরসহ খুলনা জেলায় রোগী ছিলেন মাত্র ৭৬ জন। এখন রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৫১। গত ২৬ দিনে রোগী বেড়েছে ১৯৪০ শতাংশ। এই ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে, কেউ জানে না।

খুলনা জেলা সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত ঈদের পর থেকে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। মানুষ ঘরে থাকছে না, মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। তাই সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, দুটি ওয়ার্ড ও একটি ইউনিয়ন লকডাউন করা হয়েছে। দেখা যাক কী ফল হয়।

কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি বলেছিল, ১০০ জনের কম রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন জেলাগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা দরকার। পাশাপাশি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করার কথাও বলেছিল। এসব কাজও ঠিকভাবে হয়নি। তাঁরা বলেছিলেন, মানুষের শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে এলোমেলো যাওয়া-আসা এবং অফিস-আদালত-দোকানপাট খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে বাংলাদেশ সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সংক্রমণ প্রতিরোধের চেয়ে রোগীর চিকিৎসায় বেশি জোর দিয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি চিহ্নিত করা, রোগ শনাক্ত করা, শনাক্ত হওয়া রোগীকে আইসোলেশনে নেওয়া, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা—জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। সেই মৌলিক কাজগুলো হয়নি বলেই সংক্রমণ বেড়েছে।

[প্রতিবেদন লেখায় সহযোগিতা করেছেন প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, রংপুরখুলনা]