করোনার নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা

সূত্র: আইইডিসিআর, করোনাডটগভডটবিডি
সূত্র: আইইডিসিআর, করোনাডটগভডটবিডি

সরকারি ছুটি বা কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ৩০ মে সরকারি ছুটি শেষ হয়ে যায় এবং লকডাউন পরিস্থিতি পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়। এরপর দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এবং নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে। সবকিছু খুলে দেওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে পরবর্তী মাত্র ২০ দিনে রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। এই ২০ দিনে দেশে প্রায় ৭০ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, লোকসমাগম ও যাতায়াত যত বেশি হবে কোভিড-১৯ তত বেশি ছড়ানোর শঙ্কা তৈরি হবে। দেশে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়ার বিভিন্ন পর্যায়ে এই বাস্তবতা দেখা গেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত এলাকাভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ দেন তাঁরা।

লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ শিথিল করার পর থেকে বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। গত শনিবার যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওই দেশের সংবাদপত্র গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধিনিষেধ শিথিল করার পর সংক্রমণ আরও বাড়তে দেখা গেছে, বিশ্বের এমন ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ।

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম। বেশ কিছু দিন থেকেই বাংলাদেশ এ তালিকায় আছে।

৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। সংক্রমণ ক্রমে বাড়তে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন বলা না হলেও কার্যত সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসা–বাণিজ্য, কলকারখানা বন্ধ করে অনেকটা লকডাউন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। অবশ্য পরে সেটা ঢিলেঢালা হয়েছে। বিভিন্ন জেলা লকডাউন করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এক মাসের মাথায় ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা এবং ইফতারি বিক্রির দোকান খুলে দেওয়া হয়। তখন থেকে লকডাউন পরিস্থিতি আরও ঢিলেঢালা হতে শুরু করে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণের দশম সপ্তাহ (১০ থেকে ১৬ মে) থেকে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের দুই সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ ও উপসর্গ প্রকাশ পায়।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওই ঢিলেঢালাভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে। ৩০ মে সরকারি ছুটি শেষ হয়ে যায়। আবার সবকিছু পুরোদমে চালু হতে শুরু করে। অবশ্য তারও সপ্তাহখানেক আগ থেকে ঈদুল ফিতরের কেনাকাটার জন্য দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়। তখন প্রচুর মানুষ গ্রামে যাতায়াত করে। এর সপ্তাহ দুয়েক পরে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণেও একটি লাফ দেখা যায়।

এক লাফে সংক্রমণ বৃদ্ধি

ছুটি শেষ হওয়ার পর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ বা সংক্রমণের ১৪তম সপ্তাহ থেকে এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে তিন হাজারের ওপরে চলে যায়। পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারও আগের চেয়ে বাড়তে শুরু করে।

৯ জুন প্রথম এক দিনে রোগী শনাক্ত তিন হাজার ছাড়ায়। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত এক দিন বাদে প্রতিদিনই তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ৮ মার্চ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত ৯৩ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। আর ৯ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ২০ দিনে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৬৯ হাজার ২৮৩ জন। অর্থাৎ এ সময়ে সংক্রমণ দ্বিগুণ বেড়েছে।

সংক্রমণচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি ছুটির শেষ সপ্তাহ বা সংক্রমণের ১২তম সপ্তাহে (২৪-৩০ মে) প্রতিদিন গড়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ জন। আর ছুটির পরের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৬৩১ জন নতুন রোগী শনাক্ত হন। আর ছুটি শেষ হওয়ার পরের দ্বিতীয় সপ্তাহ বা সংক্রমণের ১৪তম সপ্তাহে (৭-১৩ জুন) গড়ে প্রতিদিন ৩ হাজার ৫৬ জন নতুন রোগী যুক্ত হতে থাকেন। গত শনিবার শেষ হয়েছে সংক্রমণের ১৬তম সপ্তাহ। এই সপ্তাহে (২১-২৭ জুন) প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৬০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

এ সময়ে সংক্রমণ শনাক্তে পরীক্ষাও বেড়েছে। তবে শুধু যে পরীক্ষা বাড়ায় রোগী বাড়ছে, বিষয়টি এমন নয়। কারণ, এ সময়ে পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হারও বেড়েছে। ৯ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত সময়ে দেশে পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। মূলত মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। এর আগে সংক্রমণের তৃতীয় মাসে (৯ মে-৮ জুন) শনাক্তের হার ছিল ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সংক্রমণের প্রথম মাসে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় মাসে (৯ এপ্রিল-৮ মে) শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ঈদ উপলক্ষে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ লকডাউন কার্যত উঠে যায়। ৩১ মে থেকে সবকিছু আবার চালু হতে শুরু করে। এরপর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ আরও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। তার মানে ঈদের সময়কার ঢিলেঢালা ভাব থেকে শুরু করে লকডাউন পুরোপুরি তুলে দেওয়ার প্রভাব এটা। যার ফলে এখনো সংক্রমণ বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনা করে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দিতে হবে। সেটা সারা দেশে একসঙ্গে বা কাছাকাছি সময়েই করতে হবে।

মৃত্যু ১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে

সংক্রমণ বাড়লেও গত দুই সপ্তাহে মৃত্যুর সংখ্যা সামান্য কমেছে। গত শনিবার শেষ হওয়া সংক্রমণের ১৬তম সপ্তাহে মারা গেছেন মোট ২৭০ জন। তার আগের সপ্তাহে মৃত্যু ছিল ২৮৬ এবং তার আগের সপ্তাহ অর্থাৎ ১৪তম সপ্তাহে মারা গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ ২৯৩ জন।

 অবশ্য গত ২৪ ঘণ্টায় আগের দিনের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা আবার বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চার দিন পর গতকাল আবার এক দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ ছাড়াল। গতকাল নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩ হাজার ৮০৯ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৭। এর মধ্যে মোট ১ হাজার ৭৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়েছেন মোট ৫৫ হাজার ৭২৭ জন।

জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ১৮৮টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে মোট মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এক ধাপ উঠে ২৭তম অবস্থানে এসেছে।

সাধারণ ছুটি আর না বাড়ালেও এখন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়ার কাজ করছে। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন চলছে। তাতে এখন পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন যে রোগীর সংখ্যা ও শনাক্তের হার বেড়েছে, এটা লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রভাব। মে মাসের শেষের দিক থেকে শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করে। এখন প্রতিদিন ১৮-২২ শতাংশ নমুনা পজিটিভ বা আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে। কোনো কোনো দিন তা ২৩–এর ওপরে চলে যাচ্ছে। তাঁর মতে, এটা কমাতে হবে। পূর্ব রাজাবাজারে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের ফল ভালো পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য এলাকায়ও এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে পরিস্থিতি ভালো হবে বলে আশা করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন রাখা) ও কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করার ব্যবস্থা করা গেলে আরও ভালো হবে।