নীরবে-নিভৃতে বড় অসময়ে চলে গেলেন রেহেনা আক্তার

২০১২ সাল। আমি সদ্য সাংবাদিকতার খাতায় নাম লিখিয়েছি। সকাল সকাল প্রেসক্লাবে চলে যেতাম। শহরের কোথায় কী হচ্ছে, আজকের নিউজ কী, চলতি বিষয় কী—এসব বোঝার চেষ্টা করতাম নিয়মিত। বুকের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা, টিকে থাকার লড়াই-শেখার চেষ্টা। সাংবাদিকতা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হলেও দেখতে ছোটখাটো মানুষ ছিলাম। আমি অনেককে আগে থেকে তাঁদের কাজের মাধ্যমে চিনলেও আমাকে কেউ চিনত না। চেনার প্রশ্নও ছিল না।

আমি নিজেই ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করতাম। এই শহরের মিছিল-মিটিং, সভা-সমিতি দেখি, শিখি। ছবি তুলি, সংবাদ লিখি। নতুন সংবাদের খোঁজে থাকি। সেই সময় আমার মতো ক্যামেরা হাতে ছুটতে দেখতাম আরও কয়েকজনকে। তাঁদের মধ্যে দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব। তাঁদের প্রায়ই প্রেসক্লাবের আঙিনায় একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যেত। একদিন কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। একজন দীপা ঘোষ, অন্যজন রেহেনা আক্তার। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন দেখা হতে লাগল। কথা হতো অনেক বিষয়ে। তাঁদের প্রতিদিন কীভাবে কাজ করতে হয়, নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্ট কয়টা থাকে—এসব ব্যাপার আমি খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করতাম। ভীষণ অবাক হয়ে ভাবতাম, এই শহরে এত কষ্ট করে টিকে থাকতে হয় একজন নারীকে!

কী ঝড়বৃষ্টি, কী রোদেলা দিন—সাংবাদিকদের এ থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। সব সময়ই সমান পরিশ্রম করতে হয়। বরং বলা যায়, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ যেখান থেকে দূরে সরে যায়, সংবাদকর্মীদের সেখানেই পৌঁছাতে হয় দ্রুত। এর মানে হলো, বিপদের মুখে ঝাঁপ দেওয়াই সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত। সেই ঝাঁপ দেওয়ার সময় আলোকচিত্রীদের সঙ্গে থাকে অত্যন্ত ভারী ক্যামেরা। দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু যন্ত্র ও যন্ত্রানুষঙ্গ মিলিয়ে বেশ খানিকটাই ওজনদার আমাদের প্রিয় ক্যামেরাগুলো। ভারী ক্যামেরা কাঁধে নারী আলোকচিত্রীরা—এই গল্প নিয়ে সেই সময় প্রথম আলোয় ‘নারীমঞ্চে’ আমি একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম। তা ছিল কয়েকজন নারী আলোকচিত্রীকে নিয়ে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম রেহেনা আক্তার। কঠোর পরিশ্রমী রেহেনা আক্তার ছিলেন সরলতার অন্যতম উদাহরণ। শিশুসুলভ হাসিমাখা মুখখানা তাঁর।

রেহেনা আক্তারের শুরুটা হয়েছিল ‘বাংলার চোখ’ ফটো এজেন্সির মাধ্যমে। এরপর এফএনএস, বাংলানিউজ ২৪ডটকম। তারপর ‘ইত্তেফাক’-এ যোগ দিলেন। এর আগে বেশ কিছুদিন পাক্ষিক ‘অনন্যা’য় কাজ করেছেন। ‘ইত্তেফাক’ ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় প্রতিষ্ঠান। সব সময় আনন্দ নিয়েই কাজ করতেন এই নারী আলোকচিত্রী। মাঝে মাঝে বলতেন, আজকে পেটব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা প্রভৃতি, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে যে এত অসুস্থ, কখনো তা বুঝতে দেননি। সারা দিন কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। শেষে বাদ সাধল কঠিনতম রোগ। চিকিৎসা চলছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না এই করোনার সময়ে। অপারেশন-পরবর্তী কেমোথেরাপি সঠিক সময়ে দেওয়া যায়নি। করোনার ভয়ে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ হচ্ছিল না।

রেহেনা আপা সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। নানান রকম আলাপ হতো তাঁর সঙ্গে। তবে প্রথম কথাই থাকত, ‘সাবিনা খাইছো কিছু?’

এরপর তাঁর বাইকে লুকানো বক্সের খাবার বের করতেন। তিনি শুধুই পরিচিত সহকর্মী ছিলেন না, ছিলেন একজন বন্ধু, বড় বোন। আমার চলার পথে নানা পরামর্শ দিয়ে পাশে থেকেছেন। আমাদের প্রায় রোজই দেখা হতো। রেহেনা আপাকে কখনো কাজ ছাড়া ঘুরতে দেখতাম না। সব সময় কোনো না কোনো কাজে থাকতেন। নয়তো কোনো কাজের সন্ধানে থাকতেন। বিপদের ভয়ে যখন মানুষ ঘরে থাকে, তখন রাজপথে নেমে যান সেই নারী। আবার কাজ শেষ হতেই তড়িঘড়ি বাসায় চলে যেতেন বাচ্চাদের জন্য রান্না করতে হবে বলে। আবার বিকেল গড়াতেই অফিস। অনেক দিন দেখেছি, অফিস শেষে বাজার করে ফিরছেন।

রেহেনা আক্তার ছিলেন একজন মমতাময়ী মা, একজন সাহসী আলোকচিত্রী। কখনো কারও কাছে মাথা নিচু করেননি। অন্যকে সম্মান করে সব সময়ই হাসি নিয়ে কথা বলতেন। আমাকেও তা-ই শেখাতেন। তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগেও দেখা একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে। কাছাকাছি অফিস হওয়ায় কাজ শেষে আমরা প্রায়ই একসঙ্গে ফিরতাম অফিসে। সেদিনও একসঙ্গেই অফিসে ফিরেছি। আর কোনো অনুষ্ঠানে, কোনো অ্যাসাইনমেন্টে তাঁকে দেখা যাবে না। রাজপথের উত্তাল মিছিলের সামনে তাঁকে তাঁর প্রিয় ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে আর দেখা যাবে না। নীরবে-নিভৃতে সবার মনে প্রগাঢ় ছাপ ফেলে বড় অসময়ে চলে গেলেন রেহেনা আক্তার।