করোনাকালে এক বিদ্যালয়ের ১৩ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে ঝুঁকি এড়াতে শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ছুটির ফাঁদে একটি বিদ্যালয়ের ১৩ ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তারা।

বাল্যবিবাহের শিকার ছাত্রীদের মধ্যে একজন অষ্টম এবং ১২ জন নবম শ্রেণির। বিদ্যালয়ে মোট ছাত্রী ২১৭ জন।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ছাত্রীদের ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ রোধ এবং শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে স্কুলবাস সেবা, দুপুরের খাবার ‘মিড-ডে মিল’, পোশাক সরবরাহসহ নানা রকম প্রণোদনা দিচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়টির এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে গত ১৪ মার্চ প্রথম আলোতে ‘বেড়েছে ছাত্রীদের উপস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর বলেন, ২০১৮-১৯ সালে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদ্যালয়ের ২৫ জন ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল। চলতি পথে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করার কারণে অনেক ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন বিদ্যালয়ে মাত্র ৭০-৮০ জন ছাত্রী ছিল। ওই সময় উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় অভিভাবক সমাবেশ, ছাত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকদের তদারকি এবং নতুন ছাত্রী সংগ্রহের কারণে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বেড়েছে। এখন ২১৭ জন ছাত্রী রয়েছে বিদ্যালয়টিতে।

প্রধান শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চলেছে কঠোর নিয়ম মেনে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিদ্যালয় লম্বা ছুটির ফাঁদে পড়ে। শিক্ষকদের নজরদারির অভাব দেখা দেয়। আর ঘরবন্দী ছাত্রীদের পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। এ সুযোগে অসচেতন অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করেন। ১৫ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১৩ ছাত্রী শিকার হয় বাল্যবিবাহের।

প্রধান শিক্ষকের ভাষ্যমতে, অভাব, অজ্ঞতা আর বখাটেদের অপতৎপরতায় পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে এসব ছাত্রীর বিয়ে হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার ১৩ ছাত্রীর মধ্যে এক গ্রামের আটজন, আরেক গ্রামের চারজন এবং অপর আরেক গ্রামের একজন রয়েছে।

বাল্যবিবাহের শিকার কয়েকজন ছাত্রীর অভিভাবক জানান, বিদ্যালয় ছুটির কারণে মাসের পর মাস ঘরবন্দী তাঁদের মেয়েরা। ঠিকমতো পড়ালেখাও করে না। মেয়েদের মাথায় অপসংস্কৃতি ভর করেছে। পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেরাও বেপরোয়া। পারিবারিক সম্মানের ভয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, বিয়েতে অল্পবয়সী মেয়ে খোঁজে পাত্রপক্ষ। মেয়ের বয়স কম হলে যৌতুকের পরিমাণও কম লাগে। অভাবী মানুষের জন্য এটা একটা ভালো সুযোগ।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. মহসীন আলী আফসোসের সঙ্গে জানান, তাঁদের অর্জন ও লক্ষ্য বাধাপ্রাপ্ত হলো করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে। তিনি জানান, নারীশিক্ষা প্রসারের কথা ভেবে অজ পাড়াগাঁয়ে ১৯৯৫ সালে গড়ে ওঠে বিদ্যালয়টি। বেশির ভাগ অভিভাবক দরিদ্র। নারীশিক্ষার ব্যাপারে তাঁদের নেতিবাচক মনোভাবও রয়েছে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখা এবং ছাত্রী সংখ্যা বাড়াতে দুপুরের খাবার সরবরাহের পাশাপাশি নিজস্ব পরিবহন সেবা ও নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া হয়। এতে বাড়ে ছাত্রী এবং শ্রেণিতে উপস্থিতির সংখ্যা।

মো. মহসীন আলী আরও বলেন, নানা প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে পরিবর্তনও এসেছে। মনোযোগ বেড়েছে পড়াশোনায়। আগের তুলনায় কমে আসে ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহের সংখ্যা। ছাত্রী উত্ত্যক্তের ঘটনাও কমে আসে। এ কারণে ছাত্রীদের অভিভাবকেরা খুশি ছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে। শিক্ষকদের তৎপরতা নেই। এ সুযোগে ছাত্রীদের বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। এই সময়ে তাঁর দপ্তরের পক্ষ থেকেও নজরদারিরও অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থী সংকটের কারণে মাঝে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল বিদ্যালয়টি। শিক্ষকদের সহযোগিতায় নানা রকম সচেতনতামূলক উদ্যোগ ও ছাত্রীদের বাল্যবিবাহ বন্ধ, শতভাগ উপস্থিত নিশ্চিত করতে চালু করা হয় দুপুরের খাবার ব্যবস্থা। এতে করে ছাত্রীর সংখ্যা ও উপস্থিতি বেড়েছে। ফলাফলও ভালো করতে থাকে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ১৩ ছাত্রীর বিয়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।