শুধু অপেক্ষার দিন গুনছি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার মেয়েটি ঘরবন্দী হয়ে আছে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সে এখন মাস্টার্স করছে। আমি ওর কাছে গিয়ে মাস দেড়েক থেকে এসেছি। ফিরে আসার আগের দিন মেয়েটি মিউ মিউ করে বলেছিল আরও কয়েকটা দিন ওর সঙ্গে থেকে যেতে। ওর বাবা মেয়ের ইচ্ছাকে না করে না কখনো, কিন্তু এবার কেন যেন তিনি রাজি হলেন না। একটু অবাকই হয়েছিলাম। দেশে ফিরে এলাম ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমেই শুনলাম, আমরা রওনা দেওয়ার আগের দিন আমার বড় দুলাভাই মারা গেছেন। বুঝতে পারলাম, মেয়ে রাখতে চাইলেও তার বাবা কেন রাজি হননি।

চলে আসার দিন সকালে মেয়েটা বলছিল, শরীরটা ভালো লাগছে না, কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না। দোহায় পৌঁছেই শুনলাম, ওর জ্বর এসেছে। আমাদের এক ভাই এসে মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে। ওষুধও চলছে। ওখানে তো তখন করোনা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের মনের যে কী অবস্থা। বারবার মনে হচ্ছিল, কেন চলে এলাম! এর পরের প্রতিটি দিন যে কী দুর্বিষহ কেটেছে! ওখানে প্রবাসী সানি আর ওর স্ত্রী বৃষ্টি আর বোন অ্যানি আমার মেয়েকে কী যে সহযোগিতা করেছে, তার তুলনা হয় না। সারাক্ষণ খোঁজ রেখেছে। ওষুধ, খাবার, জুস আর প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে গেছে। বোস্টন থেকে আমার ছোট বোনও খবর রেখেছে। টাকাও পাঠিয়ে দিচ্ছে।

মন মানছিল না বলে আবারও যেতে চাইলাম, কিন্তু ও না করল। ওর জ্বরটা ছিল স্বাভাবিক। বলল, আমি যেন দেশে থেকে তার বাবাকে বরং দেখেশুনে রাখি। ওর বাবা কাজপাগল মানুষ। দায়িত্ব পালনের সময় ঘর-সংসার বা নিজের সুবিধা–অসুবিধার কথা মোটেই মাথায় থাকে না।

নিউইয়র্কে ও যেখান থাকে, সেখানকার অবস্থা মোটেও ভালো নেই। মেয়েটি আমার ভালোবাসে খোলা নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদেলা দিন, নদী, স্রোত আর সবুজ প্রকৃতি। সূর্যাস্ত দেখা ওর অসম্ভব প্রিয়। প্রতিদিন সে সেন্ট্রাল পার্কে ঘুরবে, হাডসন নদীর পাড় ধরে হাঁটবে, শীতে বরফের সৌন্দর্য দেখতে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। নইলে ওর শরীর–মন কিছুই ভালো থাকে না। শীতের শুরুতে গাছের সবুজ পাতা যখন লালচে কমলা হয়ে ওঠে, তখন শরতের ওই রং আর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সে বেরিয়ে পড়ে নানা দিকে।

সেই মেয়ে ভয়েই এখন যায় না বাইরে। বাইরে বের হওয়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করলে ফোন করে। আমরা বলি, এখন না ওখানে অনেক রাত, ঘুমাওনি? সে জবাব দেয়, বন্দীর আবার দিনরাত কী? কখন যে দিন হয় আর কখন যে রাত নামে, কিছুই বুঝি না। এভাবে থাকলে তো মানসিক রোগী হয়ে যাব।

অনলাইনে ক্লাস করতেও আনন্দ হয় না। মাঝেমধ্যে বন্ধু আর সহপাঠীদের সঙ্গে অনলাইনে আড্ডা দেয়, গ্রুপ ওয়ার্ক করে, ব্যায়াম করে, বই পড়ে, সিনেমা দেখে। এতে আর কত সময় কাটে! সামারেও ক্লাস হবে। দেশে আসতে পারবে না বলে মেজাজ আরও খারাপ।

আমরা দেশে নিজ বাসায় আছি। আর মেয়েটা কী কষ্টই না ওখানে করছে। খাওয়া নিয়ে কত কষ্ট! ওর প্রিয় খাবারগুলো কমই রান্না করি। কবে যে করোনার প্রকোপ কমবে, সে–ই বা কবে আর সুযোগ পাবে, কে জানে?

মেয়েটা বলে, তোমাদের কবে দেখতে পাব? আর ওর বাবার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়াতে থাকে। আমার তো কান্না আসে না। বুকে অব্যক্ত ব্যথা জমে ওঠে। আমাদের একমাত্র সন্তান এই মেয়েটা।
আমরা শুধু অপেক্ষার দিন গুনছি। কবে উড়ে আসবে মেয়েটা। কিংবা কখন উড়ে যাব ওর কাছে।