প্রিয় ক্যাম্পাসে সুনসান নীরবতা

ক্যাম্পাস খোলা থাকলে সবচেয়ে বেশি আড্ডা জমে ডি-বক্স চত্বরে। শিক্ষার্থী না থাকায় শেওলা জমেছে সেখানে। ছবি: প্রথম আলো
ক্যাম্পাস খোলা থাকলে সবচেয়ে বেশি আড্ডা জমে ডি-বক্স চত্বরে। শিক্ষার্থী না থাকায় শেওলা জমেছে সেখানে। ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন ফুল, পাখি আর প্রজাপতিদের দখলে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় চার মাস ধরে বন্ধ থাকা ক্যাম্পাসকে প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে সাজিয়েছে। কিন্তু সেশনজটের দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাঁদের একাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইনে ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা শিক্ষার্থীরা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বলে অনেক শিক্ষার্থীর মত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এই পদ্ধতিতে ক্লাস নিলে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

গত শনিবার সকাল থেকে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতা। থেকে থেকে নির্মাণশ্রমিকদের ঠুকঠুক শব্দ। নেই শিক্ষার্থীদের চিরাচরিত হইহুল্লোড়। পিচঢালা রাস্তা আর পাঠচক্র বেঞ্চে সবুজ শেওলা পড়েছে। বাসস্ট্যান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে বাসগুলো।

তবে গাছে গাছে ফুটেছে ফুল। বকুল, মালতী, হাসনাহেনাসহ নানান ফুল। সেসব ফুলে খেলা করছে মৌমাছি আর প্রজাপতি। পাখিদের কলরব স্পষ্ট। কদিন আগে ফল পেড়ে নেওয়ায় লিচুগাছগুলো যেন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত। শেখ রাসেল হলের সামনে থাকা গাছে ধরেছে কাঁঠাল। খেলার মাঠসহ পুরো ক্যাম্পাস যেন সবুজের দখলে।

মাঠে খেলাধুলা নেই। বেড়ে উঠেছে ঘাস। সকাল হলেই গরু-ছাগলের দখলে চলে যায় মাঠ।
মাঠে খেলাধুলা নেই। বেড়ে উঠেছে ঘাস। সকাল হলেই গরু-ছাগলের দখলে চলে যায় মাঠ।

আবাসিক হলের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন বিদেশি শিক্ষার্থী। নেপাল, ভুটান, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ১৯৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত এই ক্যাম্পাসে। করোনাকালে নিজেরাই বাজার থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত সব কাজ করছেন। ভবনগুলোর সামনে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকা অবস্থায় দম ফেলার ফুরসত থাকে না শিক্ষার্থীদের। ক্লাস-পরীক্ষা, পাঠচক্র, আড্ডাবাজিসহ নানান কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন তাঁরা। করোনা পরিস্থিতিতে ১৮ মার্চ ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণাসহ আবাসিক হল ত্যাগ করার নোটিশ দেওয়া হয়। সেই থেকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে অনলাইনে ক্লাস চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার ফজলুল হক বলেন, চলতি মাসের শুরু থেকে সীমিত পরিসরে প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। এবার শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে অনলাইনে ক্লাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অনলাইন ক্লাস গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত কিছু সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। খুব দ্রুতই সেগুলো সরবরাহ করলে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা যাবে। সে ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

বন্ধ ক্যাম্পাসে আপন মনে ফুটে আছে লাল রঙ্গন। শেখ রাসেল হলের সামনে।
বন্ধ ক্যাম্পাসে আপন মনে ফুটে আছে লাল রঙ্গন। শেখ রাসেল হলের সামনে।

দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে কেমন কাটছে, জানতে চাইলে মুঠোফোনে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় যেভাবে পড়াশোনার গুরুত্ব থাকত, সেটা অনেকাংশে কমে গেছে। কেউ কেউ চাকরির পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে প্রত্যেকেই সেশনজটের আশঙ্কা করছেন।

কৃষি প্রকৌশল বিভাগের লেভেল-৪, সেমিস্টার-২–এর শিক্ষার্থী আতিক হাসান বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে সাধারণত সাত-আট মাসের সেশনজট লেগেই থাকে। তার ওপর করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় চার মাস সময় পার হয়ে গেল। চলতি জুলাই মাসে ক্লাস শুরু হলেও পুরো ৯ মাসের সেশনজটে পড়তে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে ক্লাস চালুর বিষয়ে আতিক বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের সমস্যা থাকে। গ্রামে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেকে এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না। তা ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়তে আসেন, মেধার দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও অনেক শিক্ষার্থীই গরিব। এখনো অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁদের স্মার্টফোন নেই।

এদিকে দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে ক্যাম্পাসের আশপাশের ব্যবসায়ীদের। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসহ বাঁশেরহাট এলাকার এসব ব্যবসায়ীর মূল ক্রেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের পদচারণ নেই। পিচঢালা রাস্তায় জমেছে শেওলা। একাডেমিক ভবনের সামনে।
শিক্ষার্থীদের পদচারণ নেই। পিচঢালা রাস্তায় জমেছে শেওলা। একাডেমিক ভবনের সামনে।

বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন বাঁশেরহাট বাজার এলাকায় রেস্তোরাঁ রয়েছে ১২টি, টংদোকান ২৫ ও ফুটপাতে চায়ের দোকান ১৮টি। এ ছাড়া কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস, মুরগি, ফলমূল, কাপড়, স্টেশনারি, কম্পিউটার সার্ভিসিং, মোবাইল ফোনসহ সহস্রাধিক দোকান রয়েছে। একটি কনফেকশনারি দোকানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল হাজারী বলেন, ‘প্রায় চার মাস ধরে ভার্সিটি বন্ধ। ১৫ দিন ধরে দোকান খোলা রাখতেছি। যেখানে দৈনিক সাত-আট হাজার টাকা বিক্রি হতো, সেখানে এখন এক হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। কতগুলো মাল নষ্ট হয়ে গেছে। ড্যামেজ হয়ে গেছে। ক্যামনে যে দিন কাটাচ্ছি, নিজেও বুঝি না।’

ফলের ব্যবসায়ী জাকারিয়া বলেন, এই বাজারে বাইরের লোকজন তো তেমন আসে না। এলাকাটাও ঘনবসতি না। ছাত্রছাত্রী থাকলে ব্যবসা ভালো, না থাকলে ব্যবসা বন্ধ। তিনি সপ্তাহখানেক ধরে দোকান খোলা শুরু করেছেন। এর আগে অন্যের জমিতে ধান কাটার কাজ করেছেন।

আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ছাত্রাবাসের মালিকেরাও। বাঁশেরহাট এলাকার ছাত্রাবাস মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে অর্ধেক ভাড়া গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সেই ভাড়াও উঠছে না। শিক্ষার্থীরা না এলে ভাড়া দেবে কে? কিন্তু ব্যাংক তো আর কথা শোনে না। আমাদের অবস্থা কাউকে বলতেও পারছি না, কেউ বুঝতেও চাইছে না।’

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদে ৪৫টি বিভাগে ১২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে দুই শতাধিক ছাত্রাবাসে অবস্থান করেন।