মৃত্যুর সময়ও অচেনা শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল সায়েম

গতকাল সোমবার সদরঘাট-সংলগ্ন ফরাশগঞ্জে লঞ্চডুবিতে নিহত মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার তিলাদীচর এলাকার মো. সায়েমের মায়ের আহাজারি। সায়েমের বাড়িতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
গতকাল সোমবার সদরঘাট-সংলগ্ন ফরাশগঞ্জে লঞ্চডুবিতে নিহত মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার তিলাদীচর এলাকার মো. সায়েমের মায়ের আহাজারি। সায়েমের বাড়িতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

ধলেশ্বরী নদীর চরে সায়েমের জন্ম। নদীতেই ডুবসাঁতারে বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই বন্ধুমহলের সেরা সাঁতারু সায়েম। অজস্রবার সাঁতরে ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়েছেন দুরন্ত কৈশোরে। বালুবাহী বাল্কহেড ধরে নদীতে ভেসে বেড়িয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিন শেষে আবার ঘরেও ফিরেছেন হাসিমুখে। সায়েমের এমন সাহসকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি তাঁর মা। সন্তানকে বারবার বারণ করেছেন পানিতে এত সাহস না দেখাতে।

গতকাল সোমবার সকালে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের একজন ১৮ বছরের তরুণ মো. সায়েম। বড় ভাই সাইফুল (১৯) ও ভাগনে সৌরভের (১৬) সঙ্গে পুরান ঢাকার সাতরওজা এলাকায় কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন এই তরুণ। দুর্ঘটনা থেকে ভাই ও ভাগনে বেঁচে ফিরলেও সায়েম পারেননি। সোমবার সন্ধ্যায় সায়েমের লাশ শনাক্ত করতে যান তাঁর স্বজনেরা। সায়েমের মেজ ভাই রিয়াদও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। রিয়াদ জানান, মাথা, নাকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত ছিল সায়েমের। পেট ফুলে গিয়েছিল। আর দুহাতে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিলেন পাঁচ-ছয় বছরের অজ্ঞাত এক শিশুকে। ডুবুরিরা এই অবস্থায়ই সায়েমের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। একই প্যাকেটে সায়েমের বুকের ওপর রেখে দেওয়া হয় অজ্ঞাত শিশুটিকেও।

রিয়াদ বলেন, ‘লোকজন ভাবছিল, ওই বাচ্চাটা আমাগো আপন কেউ। কিন্তু পরে ভুল ভাঙল। সায়েম হয়তো বাচ্চাটারে বাঁচাইতে চাইছিল। মরণের আগেও শেষ চেষ্টাটা করছে। মায় কত কইছে পানিতে এত সাহস না দেখাইতে। ভাই আমার শুনল না।’ রিয়াদের সঙ্গে যোগ দেন দুর্ঘটনার সময় সায়েমের সঙ্গে থাকা সাইফুল ও সোহাগ। তাঁরা জানান, দুর্ঘটনার সময় একই সঙ্গে লঞ্চের ছাদে ছিলেন তাঁরা তিনজন। ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি তাঁদের লঞ্চে ধাক্কা দিলে সেখান থেকে নদীতে ছিটকে পড়েন তাঁরা। তারপর থেকে সায়েমকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড ইমামের চর এলাকার আফসার উদ্দিনের ছেলে সায়েম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। আজ মঙ্গলবার সায়েমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় সায়েমের মা। নির্বাক তাঁর বাবা। সায়েমের মৃত্যুর জন্য বারবার নিজেকেই দোষারোপ করছিলেন সাইফুল। নিজে বেঁচে ফেরার আনন্দের চেয়ে ভাইয়ের মৃত্যু তাঁর কাছে বড় শোকের। সে কথাই বলছিলেন বারবার।

কান্না থামছেই না সায়েমের মায়ের। আজ মঙ্গলবার মিরকাদিম পৌরসভার তিলাদীচর এলাকার বাড়িতে। ছবি: দিনার মাহমুদ
কান্না থামছেই না সায়েমের মায়ের। আজ মঙ্গলবার মিরকাদিম পৌরসভার তিলাদীচর এলাকার বাড়িতে। ছবি: দিনার মাহমুদ

সাইফুল জানান, নাজিম উদ্দিন রোডের একটি প্লাস্টিক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন তাঁরা। দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন সায়েম। আর কাজে ফিরতে চাননি। সামনে কোরবানির ঈদ। এ সময় কাজে গেলে বোনাস পাওয়া যাবে, এই আশায় জোর করেই সোমবার সায়েমকে কাজে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এ নিয়ে আক্ষেপ সাইফুলের, ‘আমরা ভাই ছিলাম কম, বন্ধু ছিলাম বেশি। এক লগে পড়ছি, খেলছি, সাঁতার কাটছি, বড় হইছি। এক লগে কাজেও গেলাম, কিন্তু ভাইরে নিয়া একলগে ফিরা আইতে পারলাম না।’

মৃত্যুর আগেও হয়তো আজন্ম চেনা নদীর জলে ডুবসাঁতার কেটেছিলেন সায়েম। পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন অচেনা অজানা এক ছোট্ট শিশুকে। মায়ের বারণ ভুলে জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন এক মানবশিশুর। কিন্তু এবার আর হাসি মুখে মায়ের কাছে ফিরতে পারেননি সায়েম। ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। সোমবার রাতেই ধলেশ্বরী নদী তীরের ইমামচর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে সায়েমকে।