বাড়িতে ২৩ শতাংশ প্রসব বেড়েছে

মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর। দেশে প্রসব–পূর্ব ও প্রসব–পরবর্তী সেবা কমে গেছে। বাড়িতে প্রসব বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এতে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বেড়েছে। অনিরাপদ গর্ভপাতও বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা সেবা দেবেন এবং যাঁরা সেবা নেবেন, উভয়ই করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় আছেন। সেবা না পাওয়ার অর্থ স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, মৃত্যু বেড়ে যাওয়া।

গত মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট বলেছে, করোনার কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে আগামী ছয় মাসে শিশু ও মাতৃমৃত্যু বাড়তে পারে। এসব দেশে পরিবার পরিকল্পনা সেবা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এর ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমবে। বাড়বে অনিরাপদ গর্ভপাত। আর প্রসব–পূর্ব ও প্রসব–পরবর্তী সেবা কমে যেতে পারে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ করে।

সরকারও এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। পরিকল্পনা কমিশনে গত সপ্তাহে এ বিষয়ে সভা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মা, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে সব সেবার মতো মাতৃস্বাস্থ্যসেবাও বিঘ্নিত হয়েছে। সেবা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছি।’

পরিস্থিতি

পরিকল্পনা কমিশনের ওই সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল। তাঁর উপস্থাপনায় দেখা যায়, গত বছর মার্চে একবার প্রসব–পূর্ব সেবা পাওয়া গর্ভবতী ছিলেন ৪২ হাজার ৫২৬ জন, এ বছর মার্চে সেই সংখ্যা কমে হয় ৩৬ হাজার ৪১৫। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় এপ্রিলে। গত বছর এপ্রিলে একবার প্রসব–পূর্ব সেবা পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৫৭১ জন গর্ভবতী। এ বছর ১৮ হাজার ৬২ জন।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্তের ঘটনা প্রকাশ করা হয়। এরপর সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার কথা সামনে চলে আসে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সতর্ক হয়। এর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যসেবার ওপর। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। আবার অনেক সেবাগ্রহীতা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া বন্ধ করে দেন।

গবেষকেরা বলেছেন, চারটি কারণে সেবা কমেছে: মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় জনবল কমেছে, সেবাসামগ্রী সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে, সেবা নেওয়ার চাহিদা কমেছে এবং সেবা ব্যবহারের সুযোগ কমেছে।

সরকারি তথ্য ব্যবহার করে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গত বছর মার্চ ও এপ্রিলে চারবার প্রসব–পূর্ব সেবা নিয়েছিলেন ২০ হাজার ৩২৬ জন নারী। আর এ বছর একই সময়ে নিয়েছেন ১৫ হাজার ৬৩১ জন নারী। গত বছর এই দুই মাসে দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছিল ২৫ হাজার ১৯২টি। এ বছর হয়েছে ২০ হাজার ৯০০টি। একই পরিস্থিতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং জেলা হাসপাতালে। একইভাবে কমেছে প্রসব–পরবর্তী সেবা।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। সরকার দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতির ওপর বেশি জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু এই দুটো পদ্ধতির ব্যবহার কমে গেছে। তবে বড়ি ও কনডম ব্যবহার প্রায় একই আছে। 

প্রভাব কী পড়ছে

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি তথ্যে দেখা যাচ্ছে প্রসূতিদের একলামশিয়া বা খিঁচুনি বেড়েছে। প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণও বেড়েছ। খিঁচুনি ও প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ দেশে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।’

করোনা মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানে প্রসব কমে যাওয়ার অর্থ প্রসব হচ্ছে বাড়িতে। বাড়িতে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। এতে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

বাড়িতে প্রসব হলে প্রসূতি প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা কম পান। দেশে মাতৃমৃত্যুর সিংহভাগ হয় বাড়িতে। মহামারি পরিস্থিতির আগে ৫০ শতাংশ প্রসব হতো বাড়িতে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ শতাংশ।

করণীয়

করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। মাতৃস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা পরিস্থিতি আগে থেকেই দুর্বল ছিল। করোনার কারণে তা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি) মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছি। সেবা চালু রাখার সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ 

মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যকে মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁরা বলছেন, ‘নতুন স্বাভাবিক জীবনে’ আগের সেবাদান কৌশল ও পদ্ধতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আগের মতো করে চলা ঠিক হবে না।