অ্যালার্ম বাজার অপেক্ষায়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এখানে এখন রাত ১০টায় সূর্য অস্ত যায়। সূর্য ওঠে ভোর ৪টার। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল! এই কয় মাস আগেই যখন শীত ছিল, তখন বিকেল চারটা বাজতে না বাজতেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যেত। সূর্য উঠত আটটার পর। আমার জার্মান জীবন শুরুই হয়েছে শীতের শুরুতে। তখনো অবশ্য তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে পৌঁছায়নি। দিনের বেলায় তো প্রায়ই ১০-১২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকত। ক্লাস শুরু হয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল খণ্ডকালীন কাজও। শীতও এল জাঁকিয়ে।

আমার কাজের শহর কাসেল। থাকিও এখানে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অন্য শহরে। বাসা থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত বাসের কথা না হয় বাদই দিই। ট্রেনেই আমার যাওয়া-আসায় রোজ দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। সূর্য ওঠে আটটার পর। আমার ক্লাস শুরু আটটায়। সেই ক্লাস ঠিক সময়ে ধরতে বাসার সামনে থেকে আমাকে প্রথমে ভোর ৬টা ৩ মিনিটের বাস ধরতে হয়। তারপর এক ঘণ্টার ট্রেন। সব শেষে আবার ৫ মিনিটের বাস।

আমার কাজও একটা চার তারকা হোটেলের সকালের শিফটে। এমনও দিন গেছে, যখন ভোর ছয়টায় কাজ শুরু হতো, বাইরে তখন অন্ধকার। নিশ্বাস টেনে নেওয়া যায় না, এমন কনকনে ঠান্ডা। ঠান্ডার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে বাতাস, শরীরের ভেতর সুঁই ফুটিয়ে দেয়। অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যায় যখন আবার বৃষ্টি নামে। বাংলাদেশের মতো ঝুমবৃষ্টি নয়। স্যাঁতসেঁতে বরফ-ঠান্ডা বৃষ্টি। গায়ে পড়লেই ঘেন্না লাগে।

রাত ১২টায় ঘুমিয়ে এই ভয়াবহ আবহাওয়ায় ছয়টায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ভোর ৫টা ২০ মিনিটের অ্যালার্মটা বেজে উঠলেই মনে হতো, মোবাইল ফোনটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলি। বন্ধ চোখে কোন দিক দিয়ে জুতা পরতাম, গায়ে জ্যাকেট জড়াতাম, কীভাবে যে বাসে উঠতাম!

সকালের যে অ্যালার্মটা আমার জার্মান জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল, সে অ্যালার্মটা গতকাল এমনি এমনিই কিছুক্ষণ বাজালাম। আজ প্রায় চার মাস হতে চলল, সেই অ্যালার্ম শোনা হয় না। আজ প্রায় চার মাস আমার কাজ নেই। ক্লাস চলছে অনলাইনে। ভোরবেলার সেই বাস-ট্রেনের যুদ্ধ আর নেই।

আমার জার্মান ফ্ল্যাটমেটরা করোনাকালীন কোয়ারেন্টিনে নিজেদের বাসায় চলে গেছে। চারজনের ফ্ল্যাটে আজ প্রায় চার মাস আমি একা। এই ফ্ল্যাটে আমি একা থাকতে চাইলে প্রতি মাসে আমাকে প্রায় ৯০ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হতো!

বাসায় বিশাল এক বারান্দা। সময়ের অভাবে হোক বা তীব্র ঠান্ডার কারণেই হোক, এই বারান্দায় কখনো পাঁচ মিনিটও দাঁড়িয়েছি কি না, মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়ছে না। অথচ এই চার মাসের প্রতিটি দিন এক কাপ কফি হাতে আমার সকালটা এই বারান্দাতেই শুরু হচ্ছে। যতটা না ঘরে কাটাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি বারান্দায়। কখনো পা ছড়িয়ে নিচে বসে, কখনো চেয়ার-টেবিল নিয়ে আয়েশ করে। আকাশ দেখছি, পাহাড় দেখছি, পাখির ডাক শুনছি।

ও হ্যাঁ, আমার এলাকায় প্রচুর পাখি। আজকাল পাখির ডাকেই ঘুম ভাঙে। মাসে দু-তিন দিন মুখে মাস্ক লাগিয়ে বাজার করতে বেরোই। ধীর পায়ে হাঁটি। অবাক হয়ে রাস্তার পাশে ফুটে থাকা ঘাসফুলের দিকে তাকাই। হাঁটার গতি কমাই, আরেকটু কাছে যাই, আরেকটু দেখি। ওই দু-তিন দিন বাদে বাকি সব দিন কেবল আমি আর আমার বারান্দা!

পাতাবাহার গাছটা পুরো বারান্দার দখল নিয়ে নিতে চায়। আমি সাবধানে লতাগুলোকে রেলিংমুখী করে দিই। ওরা আবার ফিরে আসে, আবার ঠিক করি। চারতলার বারান্দা থেকে নিচে তাকালেই বাড়ির পেছনের ছোট্ট বাগানটা দেখা যায়। ওখানে মাঝারি আকারের ঝোপের মতো নাম না জানা যে গাছটার সাদা ফুল দেখে মুগ্ধ হতাম, ফল আসার পর বুঝতে পারলাম, ওটা আসলে নাশপাতি গাছ। ফলগুলো বড় হচ্ছে। ওগুলো পাকার আগেই কি সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে?

কোয়ারেন্টিনে যারা অসম্ভব সুখী সময় কাটিয়েছে, জরিপ করলে আমার নাম তাদের প্রথম সারিতে পাওয়া যাবে। এত সুখ কয় দিন শরীরে সয়! জীবিকা যে টানছে! ব্লক অ্যাকাউন্টের টাকাও এখন শেষ পর্যায়ে। এভাবে ঘরে বসে খেয়ে সব টাকা শেষ হয়ে গেলে বাসা ভাড়া দেব কীভাবে? খাবারের টাকাই বা আসবে কোত্থেকে?

ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু আমিই কি এখন সেই অপছন্দের অ্যালার্ম ঘড়িটা আবার বেজে ওঠার অপেক্ষাই করছি না?