ঢাকাসহ ৮ বিভাগে চালু ৮৬ পত্রিকা, বন্ধ ২৫৪টি

করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগীয় শহর ও সংশ্লিষ্ট জেলায় ৮৬টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) হিসাবে, এই আটটি বিভাগীয় শহর ও সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা ৩৪০টি পত্রিকা। সেই হিসাবে ২৫৪টি পত্রিকা বন্ধ রয়েছে।

ডিএফপির সর্বশেষ হিসাব (১ জানুয়ারি ২০২০) অনুযায়ী, দেশে মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ৫৫২। মিডিয়া তালিকার বাইরেও কয়েক শ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলো প্রকাশের অনুমতি থাকলেও সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না। এ ধরনের পত্রিকাগুলোর প্রায় সবই এখন বন্ধ আছে।

এ পরিস্থিতিতে ঢাকার সাতটি বাংলা ও চারটি ইংরেজি দৈনিক ছাড়া বাকিগুলো নিয়মিত বেতন–ভাতা দিতে পারছে না। এসব ছাড়া বাকি পত্রিকাগুলোর বেতন–ভাতা কয়েক মাস পর্যন্ত বাকি। ইতিমধ্যে কয়েকটি পত্রিকার ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়েছে, কেউবা ছোট কলেবরে প্রকাশনা অব্যাহত রেখে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। অনলাইন পত্রিকাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ, দু-তিনটি ছাড়া প্রায় সব কটিরই বেতন-ভাতা বন্ধ।

অথচ ঢাকা মহানগর ও জেলায় ২৫৪টি দৈনিক পত্রিকা মিডিয়া তালিকাভুক্ত। কিন্তু করোনাকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে মাত্র ৩২টি পত্রিকা। প্রকাশনার শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি পত্রিকার একটি সংখ্যা ডিএফপির নিবন্ধন শাখায় জমা দিতে হয়।

ডিএফপি সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণের আগে স্বাভাবিক সময়ে অধিদপ্তরের নিবন্ধন শাখায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৫০টি পত্রিকা জমা হতো। এটি ৬০টিতে নেমেছিল, গত বুধবারের হিসাবে তা ১৩৪। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেও দেখা যায়, দুই শর বেশি পত্রিকা বন্ধ আছে।

বড় ঝুঁকিতে সংবাদপত্র

করোনা পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রশিল্প বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। পাঁচ-ছয়টি ছাড়া বাকি সংবাদপত্রগুলো আগেই ঝুঁকির মধ্যে ছিল। এ বছরের জাতীয় বাজেটে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের একটি দাবিও মেনে নেওয়া হয়নি।

করোনা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের পেশা ও জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ছাঁটাই, অনিয়মিত বেতন, বকেয়া বেতন—এ সবকিছু মিলিয়ে খাতটি সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। সরকারিভাবে এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে সব মিলিয়ে আবেদন ও যোগাযোগ করেছেন প্রায় এক হাজার সাংবাদিক। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সূত্র জানায়, এই সংখ্যা কিছু বাড়তে বা কমতে পারে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত মঙ্গলবার এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। কর্মহীন, করোনাকালে চাকরি হারানো ও বেতন না পাওয়া—এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সাংবাদিকদের এককালীন ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

রিপোর্টারদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি গত ঈদুল ফিতরের সময় চাকরিচ্যুত, বেকার এবং বেতন না পাওয়া প্রতিবেদকদের তালিকা করেছিল, তাতে ২৭৫ জনের নাম পাওয়া যায়। ইউনিটি সূত্র জানায়, এই সংখ্যা এখন ৩৫০ ছাড়িয়েছে। যদিও সামাজিক কারণে অনেকেই সহায়তা বা উপহার গ্রহণের তালিকায় নাম লেখাতে চান না। এ ছাড়া প্রায় ৫০০ প্রতিবেদক রিপোর্টার্স ইউনিটির উদ্যোগে আয়োজন করা সরকারি রেশন গ্রহণ করেছেন। ইউনিটির সদস্য ১ হাজার ৮১০ জন।

বিভাগে কিছু পত্রিকা প্রকাশ, জেলায় প্রায় বন্ধ

গত মার্চে করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে ঢাকায় সংবাদপত্রের এজেন্ট ও হকারদের হাতে যেত ৫৫টি পত্রিকা। বাকি প্রায় ২০০ পত্রিকার নাম ডিএফপির মিডিয়া তালিকায় থাকলেও সেগুলো বিক্রি হতো না। বছরের পর বছর এগুলো দেয়াল বা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা নামে পরিচিত। ডিএফপি, জেলা প্রশাসন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কিছু দপ্তরে এ ধরনের পত্রিকা বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হতো। করোনাকাল শুরুর পরপরই এ পত্রিকাগুলোর ছাপা বন্ধ হয়ে যায়, এখনো সেগুলো বন্ধ আছে।

এমন একটি পত্রিকার সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট পত্রিকা প্রকাশিত হয় মূলত সরকারি বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্রের জন্য। কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে ব্যবহার করে এ ধরনের পত্রিকা। এখন যেহেতু বিজ্ঞাপন নেই, অন্যের বিরুদ্ধে লেখালেখি নেই, তাই এগুলো বন্ধ আছে।’

প্রথম আলোর বিভাগীয় কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে সাত বিভাগীয় শহর ও জেলায় মোট ১৩৮টি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার কথা। এগুলোর মধ্যে ডিএফপির তালিকায় আছে ৮৬টি; কিন্তু প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা এখন ৫৪। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৩, সিলেটে ২, ময়মনসিংহে ১১, রংপুরে ৪, খুলনায় ৪, রাজশাহীতে ৮ ও বরিশালে ২২টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এই ৫৪টির মধ্যে অন্তত ২০টি প্রকাশিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে, পৃষ্ঠা কমিয়ে অথবা অনিয়মিত (বিজ্ঞাপন পাওয়া সাপেক্ষে)।

বিভাগীয় পর্যায়ে পত্রিকা প্রকাশের এই দৈন্যের মধ্যে অন্য জেলাগুলোর সব পত্রিকার প্রকাশনা প্রায় বন্ধ রয়েছে। যেমন মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা থেকে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে না। সুনামগঞ্জ জেলার সাতটি পত্রিকার মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে মাত্র একটি। দেশের অন্য জেলার চিত্রটা অনেকটা এ রকম।

ডিএফপির হিসাবে, ঢাকার বাইরে মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা আছে ২৯৮টি, এগুলোর মধ্যে ডিএফপিতে জমা হচ্ছে মাত্র ১৪টি। তার মানে, বাকি সব পত্রিকা প্রায় বন্ধ।

সাত বিভাগের চিত্র

চট্টগ্রাম থেকে ২৪টি পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি আছে। ডিএফপির তালিকায় আছে ১৬টি। এখন প্রকাশিত হচ্ছে তিনটি, বাকি তিনটি পত্রিকার ছাপা সংস্করণ বন্ধ রেখে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। শহর ও জেলা মিলিয়ে চট্টগ্রামে সাংবাদিকের সংখ্যা প্রায় ৮৫০।

খুলনায় ২১টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি আছে। করোনা পরিস্থিতির আগে এগুলোর মধ্যে ১৭টি প্রকাশিত হচ্ছিল। ডিএফপির মিডিয়া তালিকাভুক্ত পত্রিকা ১১টি। করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে চারটি পত্রিকা বাদে সব কটি বন্ধ আছে। খুলনায় মোট সাংবাদিক রয়েছেন ৩৮৭ জন। 

রাজশাহীতে দৈনিক পত্রিকা ১৪টি। ৯টি বন্ধ আছে, করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত আকারে প্রকাশিত হচ্ছে ৮টি পত্রিকা। ডিএফপির মিডিয়া তালিকায় রাজশাহীতে ১০টি পত্রিকার নাম রয়েছে। রাজশাহীতে সাংবাদিকের সংখ্যা ৪০৪।

সিলেটে ১৬টি পত্রিকা বের হয়। ডিএফপির মিডিয়া তালিকাভুক্ত পত্রিকা ১১টি। দুটি পত্রিকা ছোট কলেবরে প্রকাশিত হচ্ছে।

বরিশালে ৩৫টি পত্রিকা আছে। ডিএফপির তালিকাভুক্ত পত্রিকার সংখ্যা ১৬। কিছুদিন ধরে ২২টি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে সীমিত পরিসরে। বরিশালে সাংবাদিকদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। রংপুর শহর ও জেলায় পত্রিকা ১৪টি, ৭টি ডিএফপির মিডিয়া তালিকাভুক্ত। ৪টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। জেলায় মোট সাংবাদিক ১২৬ জন। এ ছাড়া ফটোসাংবাদিক ৪২ জন। ময়মনসিংহে ১৯টি পত্রিকা বের হয়। ১১টি ডিএফপির মিডিয়া তালিকাভুক্ত। সেখানে ১১টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, তবে বেশির ভাগই ছোট কলেবরে।

 কমেছে প্রচারসংখ্যা

করোনা অতিমারিতে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেশ কমেছিল, বিজ্ঞাপন নেমেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু লকডাউন (অবরুদ্ধ) প্রত্যাহারের পর প্রচারসংখ্যা কিছুটা বাড়ছে, বিজ্ঞাপনও ফিরে আসছে। 

এ পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের উভয় অংশ এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যম রক্ষায় ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছিল সরকারের কাছে; কিন্তু সরকার সেসব প্রস্তাব মানেনি।

ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির সম্পাদক মোহম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের সময় পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা বেশ কমেছিল, এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। হকাররাও কাজে যোগ দিচ্ছেন। আমরাও ঝুঁকি মোকাবিলা করে পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ 

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবাদপত্র দাঁড়িয়ে আছে নানা সহায়ক শক্তির ওপর। প্রচারসংখ্যা ও বিজ্ঞাপনের ওপরই মূলত নির্ভর করছে গণমাধ্যমের উঠে দাঁড়ানো এবং টিকে থাকা। 

জানতে চাইলে প্রবীণ সাংবাদিক ও সাবেক সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চলমান এই সংকটের সহজ কোনো সমাধান নেই। সংবাদপত্র অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্প। অর্থনীতি সচল হলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হলে সংবাদপত্রশিল্প হয়তো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে এটা কবে হবে, এ মুহূর্তে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

রিয়াজউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এই সংকটে সরকার গণমাধ্যমের জন্য কিছু করবে না—এটা বলে লাভও নেই। বকেয়া বিল পরিশোধ করা, ঋণ দেওয়া, বিভিন্ন কর বা নিউজপ্রিন্টের শুল্ক কমানোসহ পরোক্ষ যেসব সহায়তা সরকার করতে পারত, সেগুলোই তো এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে রয়ে গেল। তাই বড় কোনো সহায়তা সরকারের কাছ থেকে মিলবে না, এটা ধরে নিয়েই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। 

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ অফিস]